তালেবান
‘তালেবান’ বা ‘তালিবান’ ইসলামী সুন্নী মতাবলম্বী আফগানিস্তানের মৌলবাদী একটি জঙ্গি গোষ্ঠির নাম। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে তালেবানরা ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় শরীয়া আইন চালু করে নিরীহ মানুষদের হত্যা, নারী শিক্ষা নিষিদ্ধকরন, মহিলাদের উপর নির্যাতন ইত্যাদি অপকর্ম চালায়। আফগানিস্তানের ইতিহাসে তালেবানী শাসন একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। তালেবানদের উত্থানের কারণ জানতে হলে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা প্রয়োজন।
৬০ ও ৭০-এর দশকে আফগানিস্তানের রাজনীতি | + |
---|---|
১৯১৯ সালে আফগানিস্তান বৃটেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতাত্তোর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে ১৯৩৩ সালে জহির শাহকে রাজা নির্বাচিত করার পর প্রায় চল্লিশ বছর (১৯৩৩ – ১৯৭৩) দেশটিতে মোটামুটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় ছিল। ১৯৫৩ সালে জেনারেল দাউদ খান প্রধানমন্ত্রী হয়ে সোভিয়েত সহযোগিতায় আফগানিস্তানে আর্থ-সামাজিক সংস্কার সাধন করেন। এসময় বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষা ও সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা হত। ১৯৬৩ সালে দাউদ খানকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ১৯৬৪ সালের নতুন সংবিধানে রাজাকে কেবল নির্বাচিত আইনসভার সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে দেশটিতে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দাউদ খানের নেতৃত্বে এক সামরিক অভ্যুত্থানে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং প্রজাতন্ত্র হিসেবে আফগানিস্তানের আবির্ভাব ঘটে (১৯৭৩ – ১৯৭৭)। ক্ষমতা দখল করে দাউদ খান আফগানিস্তানে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেন এবং বিরোধীতাকারীদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু করেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে রক্ষণশীল ইসলামী ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতারা দাউদ খানের আর্থ-সামাজিক সংস্কারের বিরুদ্ধে স্বশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করেন। সাম্যবাদ বিরোধী ইসলামপন্থিদের এই বিদ্রোহ কালের প্রবাহে দেশি ও বিদেশি শক্তির মদদে এবং রাজনৈতিক মেরুকরণের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তিতে ‘তালেবানী’ রূপ নিয়ে আফগানিস্তানে ইসলামী শাসন প্রতিষ্টা করতে সক্ষম হয়। |
|
আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপ (১৯৭৯ – ১৯৮৯) | + |
১৯৭৮ সালে আফগান কমউিনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নূর মোহাম্মদ তারাকী ও বারবাক কামাল এক পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দাউদ খানকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে নেন। তাঁরা রাশিয়ার সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত, ইসলামী নীতি, আফগান জাতীয়তাবাদ ও আর্থ-সামাজিক ন্যায় বিচারকে দেশ শাসনের নীতি হিসাবে ঘোষণা করেন। এসময় ক্ষমতাসীন “পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান” (পিডিপিএ) দুই ভাগে ভাগ হয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে রীতিমত সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। কম্যুনিস্ট পার্টির আরেক নেতা হাফিজুল্লাহ আমিনের সাথে তারাকীর অন্তর্দ্ধন্ধের জেরে ১৯৭৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হাফিজুল্লাহর সমর্থকদের হাতে তারাকী নিহত হলে আফগানিস্তানের পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হতে থাকে। এই অবস্থায় একই সালের ২৪ ডিসেম্বর সোভিয়েত বাহিনী সরাসরি আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপ করে এবং হাফিজুল্লাহ আমিনের সরকারকে উৎখাত করে বারবাক কামালকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসান। এর প্রতিক্রিয়ায় আফগানিস্তানের রক্ষণশীল ইসলামী ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতারা তাদের সমর্থকদের নিয়ে এক হয়ে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। এই যোদ্ধারা ‘মোজাহিদিন’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধকে মোজাহিদিনরা ‘অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে ইসলামের’ ও ‘কাফেরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের’ যুদ্ধ তথা ‘জিহাদ’ বলে অভিহিত করে। বিশ্বের মুসলিম মৌলবাদী দলগুলো, আরব বিশ্ব, পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মোজাহিদিনদের সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসে।
|
|
তালেবান ও ওসামা বিন লাদেনের সূচনা পর্ব | + |
মুসলিম দেশগুলোতে মুজাহিদিনরা সোভিয়েত সেনাবাহিনী ও স্থানীয় কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধকে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ধর্মীয় যুদ্ধের (পবিত্র জিহাদ) একটা প্রোপাগান্ডা হিসাবে দাঁড় করতে সক্ষম হয়েছিলো; তাই মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোও আফগানিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। তাছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ইসলামিক স্বেচ্ছাসেবীরা আফগান মুজাহিদিনদের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য আফগানিস্তানে ঢুকতে শুরু করে। আর এই স্বেচ্ছাসেবীদের একজন ছিলেন সৌদি ধনকুবের ওসামা বিন লাদেন। তিনি নিজস্ব অর্থ, সম্পদ ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে মোজাহিদিনদের সক্রিয় সহযোগিতা করেছিলেন। ১৯৮৮ সালে আফগানিস্তানের মুজাহিদিন ক্যাম্পে আল-কায়েদা সংগঠনটি গড়ে ওঠে। এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ওসামা বিন লাদেন। শুরুতে এই সংগঠনের উদ্দ্যেশ্য ছিল আফগানিস্থানে যুদ্ধরত বহির্বিশ্বের মোজাহেদীনদের সংগঠিত করে বিশ্বব্যাপী একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।
পিডিপিএ সরকার সোভিয়েত সরকারের কাছ থেকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা পেত, অন্যদিকে মুজাহিদিনরা যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, সৌদী আরব ও অন্যান্য মুসলিম দেশ থেকে সাহায্য পেত। আফগানিস্তানের প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সহায়তায় আমেরিকা ও আরব দেশগুলো অর্থ ও অত্যাধুনিক অস্ত্র আফগান মুজাহিদদের হাতে তুলে দিত। অর্থ ও সামরিক সাহায্য পেয়ে আফগান যোদ্ধারা সোভিয়েত আর্মিকে ঘাবড়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলো। ওই সময় যুদ্ধের কারণে তিন ভাগের এক ভাগ মানুষকে পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে আশ্রয় নিতে হয়েছিলো। তালিব আরবী শব্দ যার অর্থ ‘জ্ঞান তলবকারী’ কিংবা ছাত্র। তালিবুল ইলম অর্থ ‘জ্ঞান তালাশকারী ছাত্র’। এ শব্দটি সামান্য পরিবর্তন হয়ে ‘তালিবান’ ফার্সী ভাষায় ব্যবহৃত হয়। ফার্সী ভাষায় এর অর্থ হল বহু ছাত্র। এটি পশতু ভাষায়ও একইভাবে ব্যবহৃত হয়। কুরআনিক মাদ্রাসায় তালিবান প্রাথমিক কোর্স মাত্র ২২ মাসের জন্য। তালিবান মাদ্রাসাসমূহ পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর তা কান্দাহার, হেলমন্দ, পাটিকা, খোস্ত প্রভৃতি অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এগুলোর জনপ্রিয়তা ব্যাপক হারে বৃদ্বি পায়। আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সীমান্তে আরব এবং আমেরিকান অর্থের সাহায্যে অনেক ইসলামিক স্কুল (তালেবান মাদ্রাসা) চালু করা হয়েছিলো। এখানে ফ্রি পড়াশুনা করা যেত। এই সব মাদ্রাসা স্কুলে যারা পড়তো তাদের বলা হতো “তালেব” অথবা “তালেবান”! তাদের শিক্ষক ছিল পাকিস্তানী ও স্থানীয় মোল্লারা যেমন: মোল্লা মহাম্মদ ওমর! যে কিনা পরবর্তীতে তালেবান নেতা হয়! এই সময়টায় এখানকার ছাত্রদের শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষায় উজ্জীবিত করে ও যুদ্ধের ট্রেনিং দিয়ে আফগানিস্তানে পাঠানো হতো। |
|
সোভিয়েত আর্মীর প্রস্থান (১৯৮৯) | + |
আফগানরা জাতিগতভাবেই যোদ্ধার জাতি। শত বছরের আফগান ইতিহাসে দেখা যায় এখানকার মানুষ বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত হলেও তারা উপনেবেশিক শক্তিগুলোর বিরদ্ধে একতাবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করে তুলেছিলো। বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ইতিহাস ও সংস্কৃতি এদের আগে থেকেই ছিল। সোভিয়েত রেড আর্মি দেশটির পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছোট ছোট বিদ্রোহী গোষ্ঠীর (আফগান মুজাহিদিন) প্রতিরোধের সন্মুখীন হয়েছিল! তাছাড়া তখন সারা বিশ্ব ছিল আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে চলা “কোল্ড ওয়ার” বা স্নায়ু যুদ্ধের কারণে দ্বিধা বিভক্ত। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নকে টেক্কা দেওয়ার জন্য আমেরিকা ও তার মিত্ররা মুজাহিদিনদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। সৌদি আরবের অর্থ, আমেরিকার অস্ত্র এবং পাকিস্তান থেকে ট্রনিং পেয়ে ১৯৮৬ সাল নাগাদ মোজাহিদিনরা স্থলে গেরিলা আক্রমণে কিছুটা সাফল্য ফেলেও সোভিয়েত বিমান হামলায় তারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে বিমান হামালা ও স্থলে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে বেশিরভাগ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। মুজাহিদিনদের এয়ার ডিফেন্সের কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। পরবর্তীতে আমেরিকা “স্টিংগার” নামক অ্যান্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল তুলে দেয় আফগান মুজাহিদিনদের হাতে। এ মিসাইল তখনকার সময়ে সব চাইতে অত্যাধুনিক ছিল। এটি আফগান যুদ্ধে মুজাহিদিনদের জন্য টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে কাজ করেছিল।
এই মিসাইল আক্রমণের ফলে সোভিয়েত বিমানগুলো পড়ে। অবশেষে প্রায় ১৩,০০০ সৈন্য হারানোর পর সোভিয়েত বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। সোভিয়েত সাম্রাজ্যের সংস্কারবাদী প্রধানমন্ত্রী মিখায়েল গরভাচেভের সিদ্ধান্তে ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় “জেনেভা অ্যাকর্ড” স্বাক্ষরের মাধ্যমে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান থেকে সরে আসে। প্রায় ১০ বছর ধরে চলা যুদ্ধে আমেরিকা, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের সাহায্যে যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত আফগান মুজাহিদদের জয় হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৫ বছর ব্যাপী (১৯৫৯ থেকে ১৯৭৫) ভিয়েতনাম যুদ্ধে সোভিয়েত সাহায্যপুস্ট উত্তর ভিয়েতনামের সাম্যবাদী সরকারকে উৎখাত করার জন্য দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি অংশগ্রহণে করে অবশেষে যেভাবে লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করে স্বদেশে ফিরে গিয়েছিল ঠিক একইভাবে দশ বছরের (১৯৭৯ – ১৯৮৯) আফগানিস্তান যুদ্ধে মার্কিন সাহায্যপুস্ট মোজাহেদীনদের কাছে সোভিয়েত বাহিনী পরাজিত হয়ে স্বদেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। ওসামা বিন লাদেনও নিজের দেশে ফিরে যায় ইসলামিক হিরো হিসেবে। ওই সময় সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আফগান মোজাহেদীনদের বিজয়কে বিশেষ করে মৌলবাদী মুসলিম দেশ, সরকার ও দলগুলো “কাফেরদের বিরুদ্ধে ইসলামের বিজয়” হিসাবে আখ্যায়িত করে। এতে আল-কায়েদার অতি উৎসাহী স্থানীয় ও বহিরাগত মোজাহিদেনদের অনেকেই আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তথাকথিত ইসলামের বিজয়কে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। |
|
তালেবানি রাষ্ট্রের উত্থান (১৯৯৬) | + |
উল্লেখ্য, সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের বিভিন্ন গোত্র, এলাকা ও ভাষাভিত্তিক যেসব সশস্ত্র দল যুদ্ধ করেছিল তারা সোভিয়েত প্রস্থানের পর প্রত্যেকে নিজেদের এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠলো। কেন্দ্রে নজিবুল্লাহ সরকার নামেমাত্র ক্ষমতায় থাকলেও কাবুলের বাইরে এই সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এমনকি নজিবুল্লাহ নিজেই জীবন বাঁচানোর জন্য কাবুলে অবস্থিত জাতিসংঘের অফিসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সারা দেশব্যাপী লুঠতরাজ, ধর্ষণ, বলাৎকার, চাঁদাবাজী ও ব্যাপক অরাজকতার কারণে গৃহযুদ্ধের সৃষ্টি হলো। তালেবানগণ সর্বপ্রথম বিচ্ছিন্নভাবে এসব অন্যায়ের বিরুদ্বে আন্দোলন গড়ে তুলে। বিশেষ করে বিভিন্ন জায়গায় নারী ধর্ষণ, আফিম ব্যবসা, চাঁদাবাজী এবং লুন্ঠনবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে। এতে তালেবানরা স্থানীয় লোকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাছাড়া দীর্ঘ যুদ্ধের কারণে ক্ষত-বিক্ষত আফগানিস্তানের যুদ্ধক্লান্ত জনগণ মোজাহিনদের ক্ষমতা দখলের আভ্যন্তরীন লড়াইয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দেশের শাসনক্ষমতা তালেবানদের হাতে ন্যস্ত করার পক্ষে সমর্থন দিতে লাগলো। বিশেষ করে পশতুভাষী পাঠানরা ছিল তালেবানদের সবচেয়ে বড় সমর্থক। এইভাবে কান্দাহারের এক মাদ্রাসার শিক্ষক, প্রাক্তন মুজাহেদিন ও সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে এক চোখ হারানো মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে তালেবানীদের উত্থান ঘটে। পাকিস্তান এসময় তালেবানদের সমর্থন করে বিভিন্ন সাহায্য-সহযোহিতা দিতে শুরু করে। তালেবানরা মোল্লা ওমারকে তাদের প্রধান নেতা হিসেবে নির্বাচিত করে এবং তাদের প্রধান সেনাপতি হন নূর হাকমন। তাদের আরেকজন নেতা হলেন মোহাম্মদ রাব্বী।
কান্দাহারের সাধারণ একজন মোল্লা উমর তালিবান নেতা হিসাবে ঘোষণা করলেন যে, তিনি একটা খাঁটি ইসলামিক স্টেট প্রতিষ্ঠা করতে চান। তখন আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধের সুযোগে মোল্লা ওমর আফগানিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের ঘোষণা দিয়ে বিপুল সংখ্যক অনুসারী (বিশেষ করে পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় রিফিউজি ক্যাম্পের মা্দ্রাসার ছাত্ররা) তৈরি করেন। রিফিউজি ক্যাম্পের সামরিক ট্রেনিং ও সীমান্তের অপর পাড়ে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থাকায় খুব দ্রুতই মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে গঠিত তালেবান অদম্য হয়ে উঠলো। ১৯৯৪ সালের মাঝেই মোল্লা ওমর ও তার অনুসারীরা আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কান্দাহারের নিয়ন্ত্রণে নেয় অন্য কোন গোষ্ঠীর কাছে থেকে কোন রকম প্রতিরোধ ছাড়াই। সেখানে তাঁর ভাষায় ইসলামী সরিয়া আইন চালু করে। সাধারণ মানুষও চাইছিলো গৃহযুদ্ধের অবসান হোক। দেখা গেলো সাধারণ মানুষের সহায়তায়ই তালেবানরা একের পর এক প্রদেশ দখল করতে থাকে। তারা প্রথমে গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ার বাহিনীকে পরাস্ত করে তাদের দখলকৃত এলাকাসমূহ অধিকারভূক্ত করে নেয়। অতঃপর তারা ধীরে ধীরে কাবুলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সেসময়ের ক্ষমতাধর গোষ্ঠী আহমদ শাহ মাসুদ বাহিনীর কাছ থেকে তারা ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয় এবং সেখানে তাদের আধিপাত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। তালেবানগণ ১৯৯৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রায় সমগ্র আফগানিস্তান দখল করে নেয়। তাদের অধিকারভূক্ত জায়গার পরিমাণ ছিলে মোট আফগানিস্তানের ৭০ শতাংশ। । তালেবানরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডাঃ নজিবুল্লাহ ও তাঁর ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে রাজপথে ঝুলিয়ে রাখে। নজিবুল্লাহ সরকারের সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্য (Northern Alliance) কাবুলের উত্তরে পার্বত্য এলাকায় অবস্থান নিয়ে তালেবানদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখে। তখন ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানে আবার ফিরে আসে। বিন লাদেন ও মোল্লা ওমর নিজেদের মাঝে নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলে। ধারনা করা হয় অর্থের মাধ্যমেই সৌদি ধনকুবের ওসামা বিন লাদেন তালেবানদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। |
|
তালেবানদের ক্ষমতা দখলের কারণসমূহ | + |
|
|
তালেবানদের শরীয়া আইন ও কার্যক্রম (১৯৯৬ – ২০০১) | + |
তালেবানরা কাবুল দখল করে একটি নৃশংস ও বর্বর শাসনব্যবস্থা চালু করে। সরকার পরিচালনার জন্য মজলিশে শুরা প্রতিষ্ঠা করে মোল্লা ওমরকে আমীরুল মুমিনীন হিসেবে নির্বাচিত করে। প্রত্যেক এলাকায় ইসলামী আইনকানুন বাস্তবায়নের জন্য তালিবানী আদর্শে দীক্ষীত মোল্লাদের শরীয়া পুলিশ হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। রেডিও কাবুলের নাম পরিবর্তন করে ‘রেডিও সরিয়া’ রাখে। সব রকম টেলিভিশন, খেলাধুলা, গান, বাজনা, স্যাটেলাইট টেলিভিশন নিষিদ্ধ করা হয়। কেউ এর ব্যতিক্রম করলে নির্দয় ভাবে শাস্তি দেয়া হত। নারীদের বাড়ির বাইরে কাজ করা বন্ধ করা, বোরখা পরে বাহিরে যেতে বাধ্য করাসহ বিভিন্ন নিয়ম চালু করে। শরীয়া আইনে বিচার করে উন্মুক্ত ময়দানে জনসন্মুখে মাথায় গুলি করে অপরাধীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হত।
তালেবানদের কার্যক্রমের কিছু নমুনা নিম্নে দেওয়া হল:
তালেবানদের সাথে বহিঃবিশ্বের সম্পর্ক মোটেই ভালো ছিল না। পার্শ্ববর্তী দেশ ইরান শিয়া প্রধান দেশ। তাই তারা গোঁড়া সুন্নীদের এই আবির্ভাবকে সুনজরে দেখতে পারে নাই। আধুনিক ও গণতান্ত্রিক মুসলিম দেশগুলো আফগানিস্তানে ইসলামের নামে মধ্যযুগীয় বর্বরতার কারণে তালেবানদের সাথে সম্পর্ক রাখে নাই। শুধুমাত্র পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত তালেবানদের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। বিশ্বের উদারপন্থি গণতন্ত্রমনা মুসলমানেরাও তালেবানদের শরীয়া আইনকে ভালো চোখে দেখেনি। |
|
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ও তালেবানের পতন (২০০১) | + |
যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়ে গিয়েছিলো তাই আফগানিস্তানের প্রতি আমেরিকার আর তেমন আগ্রহ ছিল না এবং আফগানিস্তানকে আর কোন আর্থিক দেওয়ার প্রয়োজনও মনে করল না। এতে তালেবানদের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ঠানাপোড়ন সৃ্ষ্টি হয়। জাতিসংঘ তালেবান সরকারকে বিরোধীদের সাথে শান্তি স্থাপনের প্রস্তাব দেয়। এ ব্যাপারে রোমে অবস্থানরত সাবেক আফগান বাদশাহ জহির শাহ এক নতুন প্রস্তাব দিলে তালেবানরা তা প্রত্যাখান করে। তখন জাতিসংঘ আফগানিস্তানের ব্যাপারে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের অবস্থা আরো নাজুক হয়ে পড়ে। সেইসাথে আল-কায়েদা নেতা বিন লাদেন ঘোষণা করেন আমেরিকানরা মুসলমনের শত্রু তাদেরকে হত্যা করতে হবে। তখন কেনিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে আমেরিকান দূতাবাসে বিন লাদেনের আল কায়দা হামলা চালায়। আমেরিকা তখন তালেবান নেতা মোল্লা ওমরকে চাপ দিতে থাকে–বিন লাদেন তালেবান সহায়তায় সন্ত্রাসী হামলা করছে আমেরিকানদের বিরদ্ধে। কিন্তু মোল্লা ওমর সেটা অস্বীকার করে। ২০০১ সালের মার্চ মাসে আফগানিস্তানের বামিয়ান উপত্যকায় প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো ঐতিহাসিক দুটি বৌদ্ধমূর্তি তালেবানরা গুড়িয়ে দেয়। এই ঘটনার পর পুরো পৃথিবী জুড়ে তালেবান বিরোধী একটা মনোভাব গড়ে উঠে! এভাবে তালেবানরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে। এই সময় সৌদি আরবও তালেবনাদের আর্থিক সাহায্য দেয়া বন্ধ করে দেয়। বাকী থাকে কেবল পাকিস্তান।
২০০১, সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখে (৯/১১) আল-কায়েদার আত্মঘাতী জঙ্গীরা যাত্রীবাহী কয়েকটি বিমান হাইজ্যাক করে, তার মধ্যে যাত্রীসহ দুটো বিমান নিয়ে জঙ্গীরা আমেরিকান টুইন টাওয়ারে এসে হামলে পড়ে। এতে দুটো বিশাল ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে এবং ভবন দুটো ভেঙ্গে পড়ে প্রায় তিন হাজার মানুষ নিহত হয় এবং কয়েক হাজার আহত হয়। তখনকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ তালেবানদের আলটিমেটাম দেয়, ওসামা বিন লাদেন এবং আল কায়েদার সদস্যদের আমেরিকার হাতে তুলে দিতে হবে। কিন্তু তালেবান নেতা মোল্লা ওমর অস্বীকার করেন। মোল্লা ওমর লাদেনের পক্ষ নিয়ে ঘোষণা করেন, “অর্ধেক আফগানিস্তান এমনিতেই রাশিয়ান আর্মি দ্বারা ধ্বংস হয়ে গেছে; বাকীটা যদি আমেরিকার জন্য হয় তো হোক। আমি মাথা নত করবো না এবং বিন লাদেন আমার অতিথি। আমরা অতিথির অসম্মান করতে পারি না”! এই ঘোষণার পর আমেরিকা শেষ পর্যন্ত ২০০১ সালের অক্টোবর মাসের ৭ তারিখ আফগানিস্তান আক্রমণ করে বসে। এভাবেই এক সময় যেই আমেরিকা ধর্মকে পুঁজি করে, অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সোভিয়েত আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তালেবানদের সাহায্য করেছিলো; সেই আমেরিকাই আবার এই তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে এবং পাকিস্তানও আমেরিকার চোখ রাঙানিতে রাতারাতি বোল পাল্টে তালেবানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আমেরিকার সাথে জোটভুক্ত আরো কয়েকটি দেশ এবং স্থানীয় উত্তরাঞ্চলীয় জোট বাহিনীর যৌথ আক্রমণে ২০০১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের অবসান ঘটে। আক্রমণে বেশিরভাগ তালেবানী নিহত হলেও মোল্লা ওমর ও বিন লাদেন গোপনে পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর সেনাবাহিনীর সহায়তায় ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় হামিদ কারজাই সরকার। |
|
তালেবান সরকারের পতনের কারণসমূহ | + |
|
|
তালেবানদের বর্তমান অবস্থা | + |
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্ররা ‘তালেবান’ শাসনের অবসান ঘটিয়ে আফগানিস্তানের সার্বিক প্রেক্ষাপটে ব্যাপক পরিবর্তন আনার পর সেখানে গণতন্ত্র প্রচলিত হয়েছে। তবে এই গণতন্ত্র এখনো স্থিতিশীল হয়নি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করছে। ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত হামিদ কারজাই আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের ৫ এপ্রিল তারিখে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ, আফগানিস্তানের সাবেক অর্থমন্ত্রী আশরাফ গনি আহমদজাই।
উল্লেখ্য, ২০০১ সালে কান্দাহারের অদূরে মোল্লা ওমরের সদর দপ্তরে মার্কিন আক্রমণের পর মোল্লা ওমর ও ওসামা বিন লাদেন গোপনে পাকিস্তান পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। ২০১৩ সালে মোল্লা ওমরের মৃত্যু হলে মোল্লা আখতার মনসুর তালেবানদের নেতা নির্বাচিত হন। ২০১৬ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন আক্রমণে আখতার মনসুর নিহত হলে খায়বাতুল্লাহ আখুন্দজাদা নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তালেবানরা এখনও চোরাগোপ্তা ও আত্মঘাতী হামলা করে তাদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে। তালেবানীরা আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আত্মগোপন থেকে বিদেশি সৈন্য ও বর্তমান আফগান সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সব যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্টার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে বর্তমান আফগান সরকার তালেবানদের সাথে আলোচনার সম্ভাব্যতা নিয়ে কথা বলতে কাবুলে তালেবান, আফগান সরকার, পাকিস্তান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা বসেছিলেন। তালেবানরা বলেছে, আফগানিস্তান থেকে সব বিদেশি সেনা না সরালে, আন্তর্জাতিক কালো তালিকা থেকে তালেবান নেতাদের নাম বাদ না দিলে এবং বন্দি তালেবান সদস্যদের মুক্তি না দিলে তারা আলোচনায় বসবে না। আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের পর দেড় দশক কেটে গেলেও দেশটিতে আজও শান্তি আসেনি। সেখানে এক অন্তহীন যুদ্ধ চলছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করে। দেশটিতে এখনো কয়েক হাজার মার্কিন সেনা আছে। কিন্তু যে তালেবান ও আল-কায়েদাকে সমূলে উৎখাত করতে আফগানিস্তানে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র, তারা এখনো ঠিকে আছে। নতুন করে যুক্ত হয়েছে আইএসের উৎপাত। ভয়ংকর সব জঙ্গি হামলায় আফগানিস্তানে প্রায় প্রতিদিনই রক্ত ঝরছে। বিভিন্ন প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আফগানিস্তানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এখন তালেবানের নিয়ন্ত্রণে। যুদ্ধ-সংঘাতে আফগানিস্তানের অবকাঠামোও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। এই ক্ষতির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভুক্তভোগী দেশটির সাধারণ মানুষ। আফগান সরকারের অবস্থাও খুব একটা ভালো না। তাদের ভিত্তি দুর্বল। অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও সর্বব্যাপী দুর্নীতিতে সরকারের অবস্থা লেজেগোবরে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আফগানিস্তান এক ‘গলার কাঁটা’। ইতিমধ্যে দেশটিতে তাদের অনেক সেনার প্রাণ গেছে। গুনতে হয়েছে বিপুল খরচ। তারা চাইলেও হুট করে আফগানিস্তান থেকে উঠে আসতে পারছে না। আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনারা পুরোপুরি সরে এলে দেশটির পরিস্থিতি যে কী হবে, তা তালেবানের সাম্প্রতিক তৎপরতায় অনুমান করা যায়। |
|
আল-কায়েদা৯/১১ এর ঘটনার পর আল-কায়েদা সারা বিশ্বে ব্যপক পরিচিতি লাভ করে। আল-কায়েদার সন্ত্রাসী কার্যকলাপে অনুপ্রাণিত হয়ে বিভিন্ন দেশের ইসলামী মৌলবাদী দলগুলো আল-কায়েদার সাথে নেটওয়ার্ক স্থাপন করে সংগঠিত হতে থাকে। আল-কায়েদার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে বা অনুপ্রেরণায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠে ইসলামী জঙ্গি সংগঠন। |
|
আল-কায়েদার উত্থান | + |
বিশেষ করে আরব দেশগুলো থেকে যেসব যোদ্ধা আফগানিস্তানে মোজাহেদিনদের সাহায্য করতে এসেছিলেন তারা ১৯৮৮ সালে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগ করার পর ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে আল-কায়েদা (The Base) সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে নতুন জেহাদের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ১৯৯১ সালে লাদেন সুদানে এসে ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করে পাশ্চাত্য দেশগুলোর বিরুদ্ধে জেহাদ করার প্রস্তুতি শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্র লাদেনকে বহিষ্কার করার জন্য সুদানের ওপর চাপ সৃষ্টি করলে ১৯৯৬ সালে লাদেন আবার আফগানিস্তানে ফিরে কাবুল সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে পার্বত্য এলাকায় ঘাঁটি স্থাপন করেন। গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে আরব বিশ্বের সকল দেশ থেকে আমেরিকানদের বিতাড়িত করার জন্য বিন লাদেন তার অনুগত যোদ্ধাদের নির্দেশ দেন। ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে “World Islamic Front for Jihad Against Jews and Crusaders”-এর পক্ষ থেকে লাদেন এই মর্মে ফতোয়া জারি করেন যে, বিশ্বের যে কোনো দেশে যে কোনোভাবে আমেরিকানদের হত্যা করা প্রতিটি মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। এর কয়েক মাস পর লাদেনের নির্দেশে কেনিয়া এবং তানজানিয়াতে আমেরিকার দূতাবাসে আত্মঘাতী গাড়িবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কয়েকশ লোককে হত্যা করা হয়।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আল-কায়েদার ১৯ জন আত্মঘাতী সদস্য চারটি মার্কিন বেসামরিক বিমান হাইজ্যাক করে নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও ওয়াশিংটনে অবস্থিত পেন্টাগনের হেড কোয়ার্টারের সাথে বিমানগুলোকে ক্রাশ করে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে । এতে প্রায় ৩০০০ লোক নিহত হয়। এটি ছিল আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী আক্রমণ। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সন্ত্রাস তথা আল-কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং বিভিন্ন দেশে আল-কায়েদার সদস্যদেরকে ধরপাকড় শুরু করে। এতে বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি হয়। আফগানিস্তানে আশ্রয় নেওয়া লাদেনকে তালেবানরা ফেরত না দেওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আকমণ করলে লাদেন পালিয়ে পাকিস্তান চলে যায়। সেখানে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকার পর ২০১১ সালের মে মাসের ২ তারিখে দিবাগত রাতে পাকিস্তানের আ্যবোটাবাদ শহরে মার্কিন কমান্ডোদের হামলায় ওসামা বিন লাদেন নিহত হয়। এরপরও আল-কায়েদার সন্ত্রাসী কর্মকান্ড থামেনি বরংচ আরো বেড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠে আল কায়েদের শাখা এবং স্থানীয় মৌলবাদী ইসলামী দলগুলো আল কায়েদার আদর্শে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। |
|
আল-কায়েদা ও সমমনা সন্ত্রাসী গ্রুপ | + |
আল-কায়েদার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে বা অনুপ্রেরণায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠে ইসলামী জঙ্গি সংগঠন। যেমন: আইএসআইএস (সিরিয়া-ইরাক), বোকো হারাম (নাইজেরিয়া), তেহরিক-ই-তালিবান (পাকিস্তান), লস্কর-ই-তৈয়িবা (পাকিস্তান), আল-শাবাব (সোমালিয়া), এদের কার্যকলাপ হচ্ছে পাশ্চাত্য দেশসমূহের মানুষ ও সম্পদের ক্ষতি সাধন করা, ভিন্ন তরিকার মুসলমানদের (শিয়া , খারিজী, সুফিবাদী) হত্যার ভয় দেখিয়ে “শুদ্ধিকরণ” করা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশসমূহের সরকার ও সরকারি বাহিনীর ওপর চোরাগুপ্তা ও আত্মঘাতী হামলা করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্টা করা। এদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে শরিয়া আইন চালু করা। |
|
আল-কায়েদা ও বাংলাদেশ | + |
বাংলাদেশে গড়ে ওঠা জামা’আতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশ জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ হুজি, হিযবুত তাহরীর, জামায়তুল মুসলেমিন, জাদিদ আল কায়দা, জুমা’আতুল আল সাদাত, তামির উদ-দীনের একটি অংশের সদস্যরা আনারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা। তারা আল-কায়েদা নেতা আনোয়ার আল আকীকে আইকন হিসেবে মনে করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে সংগঠনের নতুন শাখা গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন জাওয়াহিরি। ৫৫ মিনিটের ভিডিওতে ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমারসহ গোটা উপমহাদেশে জিহাদের পতাকা তুলে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন তিনি। একই সঙ্গে অঞ্চলটির মুসলমানদের এক করতে সব কাল্পনিক সীমানা মুছে দেওয়ারও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত নিরঙ্কুশ শরিয়ত শাসন কায়েম করাই আল কায়েদার লক্ষ্য। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা ভারত ও মিয়ানমারে কাজ করতে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে পারে। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুদ করে তারা সেগুলো সরবরাহ করতে পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ সীমান্ত ব্যবহার করতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এর সাবেক কর্মকর্তা ব্রুস রিডেল। উত্তর আফ্রিকা ও ইয়েমেনে আল-কায়েদার শক্তিশালী শাখা আছে। তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো সোমালিয়া থেকে সিরিয়া এবং পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে সক্রিয়। আল-কায়েদার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অধিকাংশ বিশ্লেষক ইরাক ও সিরিয়ায় লড়াইরত সুন্নি জঙ্গিদের সংগঠন আইএসের প্রসঙ্গ এনেছেন। তাঁদের মতে, আইএসের নৃশংস ও অপ্রতিরোধ্য তৎপরতার প্রেক্ষাপটে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণে ভারতীয় উপমহাদেশে শাখা খোলার ঘোষণাটি দিয়ে থাকতে পারেন জাওয়াহিরি। আল-কায়েদার এই ঘোষণাকে জঙ্গিগোষ্ঠী হিসেবে বিশ্বমঞ্চে তাদের টিকে থাকার লড়াই হিসেবে বর্ণনা করেছেন কেউ কেউ। |
|
আইএসআইএস-এর নাটকীয় উত্থান ও ভয়াবহ সন্ত্রাসী তান্ডব নিয়ে বিশ্বে চলছে এক ধরনের কৌতূহল আর ভীতি। কারণ আল কায়েদার পর আইএস বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে সংগঠিত ও আর্থিকভাবে ধনী গোষ্ঠি বলে বিবেচিত হচ্ছে। সুন্নি আরব জঙ্গিদের সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিস্ময়কর উত্থানে ওসামা বিন লাদেনের জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার প্রভাব এখন চাপা পড়ে গেছে। ২০১৪ সালের আগস্টের শুরুতেই সিরিয়ার রক্কায় নিজেদের আধিপত্য কায়েম করে আইএস ৷ প্রথমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা এবং পরবর্তীতে রাশিয়াও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) যোদ্ধাদের ওপর বিমান হামলা শুরু করে। |
|
আইএসের উত্থান | + |
ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড দ্য লেভান্ট (সংক্ষেপে আইসিল) ইরাক ও সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারকারী সুন্নি আরব জঙ্গিদের একটি সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন। এছাড়াও তারা লিবিয়ার পূর্বাঞ্চল, মিশরের সিনাই উপদ্বীপ এবং মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে সক্রিয় রয়েছে। এছাড়াও এই দল ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড সিরিয়া বা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড আল শাম (সংক্ষেপে আইসিস) নামেও পরিচিত। ২০১৪ সালের জুনে দলটি তাদের নাম বদলে ইসলামিক স্টেট (আইএস) রাখে। এটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা থেকে বেরিয়ে এসে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইরাক, সিরিয়া, জর্ডান ও লেবাননের অংশবিশেষ নিয়ে একটি অঞ্চলজুড়ে ‘খিলাফত’ পদ্ধতির ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে আইএস। ১৯৯৯ সালে জর্ডানের নাগরিক আবু মুসাব আল জারকাবি জামাত আল তাওহিদ ওয়াল জিহাদ নামে একটি জঙ্গী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর আগ্রাসনের পরের বছর জারকাবী ওসামা বিন লাদেনের সংগঠন আল-কায়েদার প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে দলের নতুন নাম ‘তানজিম কাইদাত আল জিহাদ ফি বিলাদ আল রাফিদাইন’ রাখে। এটি সাধারণভাবে আল কায়েদা ইরাক (একিউআই) নামে পরিচিতি। এরা এসময় বিদেশি কূটনৈতিক অফিস, যুক্তরাষ্ট্রের কনভয় এবং বিভিন্ন শিয়া মসজিদে আত্মঘাতি হামলা করে। ২০০৫ সালে আল-কায়েদা নেতা আইমান আল-জাওহেরি ইরাক থেকে পশ্চিমা দেশের সৈন্যদের উৎখাত করে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেয়। ২০০৬ সালে একিউআই আরেকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী মুজাহিদিন শুরা কাউন্সিলের সাথে যোগ দেয় এবং পরে তারা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক (আইএসআই) নামক ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দেয়। ২০০৬ সালের জুন মাসে মার্কিন হামলায় নিহত হন একিউআই’র প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান আবু মুসাব আল-জারকাভি। ২০০৭ সালে আইএসআই ইরাকের আল আনবার, নিনেভেহ, কিরকুক ও অন্যান্য স্থানে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান লাভ করে। শীর্ষ নেতা আবু আইয়ুব আল-মাসরী ও আবু উমর আল-বাগদাদীর মৃত্যুর পর ২০১০ সালে আবু বাকার আল-বাগদাদিকে নেতা নির্বাচন করা হয়। এরপর সিরিয়ার ভেতর অস্থিরতার সুযোগকে কাজে লাগানো শুরু করে তারা। ২০১১ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার-আল-আসাদবিরোধী একটি অংশ তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এর মধ্য দিয়ে তারা এটি বিপুল অস্ত্রভাণ্ডারের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং সিরিয়ায় একটি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান পায়। একই সময়ে ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী প্রত্যাহার করলে দেশটির শিয়া নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে সুন্নি জনগোষ্ঠীর তীব্র রোষ আইএসআইএস-কে সুযোগ করে দেয়। ২০১৩ সালের আদিবাসীদের সহযোগিতায় ইরাকের ফালুজা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয় এই জঙ্গিগোষ্ঠী। চলতি বছরের জুনে ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল দখল করে নেয় তারা। এরপর ইরাকের সরকারি বাহিনীকে হটিয়ে একের পর শহর-অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় আইএসআইএস। ইরাক ও সিরিয়ায় নিজেদের দখলে থাকা অঞ্চল নিয়ে ২৯ জুন ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় তারা। একই সঙ্গে সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ইসলামিক স্টেট (আইএস)। সংগঠনের প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদি তাদের খলিফা। তাদের রাজধানী সিরিয়ার আল-রাকাহ শহর। ইরাক, সিরিয়া, জর্ডান ও লেবাননের অংশবিশেষ নিয়ে একটি অঞ্চলজুড়ে ‘খিলাফত’ পদ্ধতির ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে আইএস। তাদের সেই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে শরিয়া আইনের ভিত্তিতে। লক্ষ্য অর্জনে সংগঠনটির নেতা আবু বকর আল-বাগদাদির প্রতি আনুগত্য প্রকাশে মুসলিম বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আইএস। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশে তাদের মিত্রও তৈরি হয়েছে। বর্তমানে ইরাক ও সিরিয়ার প্রায় ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা আইএসের দখলে আছে বলে কেউ কেউ ধারণা করেন। কারও কারও মতে, সংগঠনটি প্রায় ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। এই এলাকায় প্রায় ৮০ লাখ মানুষের বাস। দখলকৃত এলাকায় কঠোর শরিয়া আইন কার্যকর করেছে আইএস। ইরাক ও সিরিয়ার বাইরে লেবাননেও তৎপর গোষ্ঠীটি। |
|
আইএস’র নিষ্ঠুরতা | + |
সম্প্রতি ইরাক ও সিরিয়ায় গণহত্যা চালিয়ে ব্যাপক কুখ্যাতি অর্জন করেছে আইএস। এসব গণহত্যার চিত্র ইন্টারনেটে প্রকাশ হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় ওঠে। মার্কিন সাংবাদিক জেমস ফলি ও স্টিভেন সটলফকে শিরচ্ছেদে হত্যার মধ্য দিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আঘাত হেনেছে আইএস। আইএস এর হাতে বন্দি ইয়াজিদি নারীদেরকে আইএস জঙ্গিরা ব্যবহার করছে যৌনদাসীর মত। তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না ছোট শিশু সঙ্গে থাকা নারীরা এমনকি ১২ বছর বয়সী মেয়েরাও। প্রতিদিনই তাদের ওপর চলছে বর্বর নির্যাতন। ইরাকে একের পর এক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বড় ধরনের হুমকি হয়ে ওঠা ‘দ্য ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ত’ (আইএসআইএল) বা ‘আইএস’ জঙ্গিদের নিষ্ঠুরতার শিকার হওয়ার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছে এক ইয়াজিদি নারী। যুক্তরাজ্যের যে সব জঙ্গি সিরিয়া ও ইরাকে যুদ্ধ করছে তারা টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যমে অত্যন্ত গর্বভরে ইয়াজিদি এসব নারী অপহরণ করে তাদেরকে ‘সেবা দাসী’ করার খবর দিয়েছে। তাদের নিষ্ঠুরতার বর্ণনায় কিশোরীটি জানায়, জানালা বন্ধ একটি ভবনে তাদেরকে রাখা হয়েছে। সার্বক্ষণিক পাহারায় আছে অস্ত্রধারীরা। |
|
আইএস দমনে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার হস্তক্ষেপ | + |
২০১৪ সালের অগাস্টে জঙ্গি এ গোষ্ঠীর উপর বিমান হামলার সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র; তাদের নেতৃত্বে গঠিত হয় বহুজাতিক জোট। এ অভিযানে সুন্নী জঙ্গীদের প্রধান ঘাঁটি রাকার ওপর ও ইরাক সীমান্ত বরাবর বিমান ও সমুদ্র থেকে বহুসংখ্যক টোমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও লক্ষ্যভেদী বোমা বর্ষণ করা হয়। আইএসবিরোধী এ হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গী হয়েছে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জর্ডান, নেদারল্যান্ড, বাহরাইন, সৌদি আরব, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। রাশিয়া এ জোটের সদস্য নয়, তবে মিত্র আসাদের পক্ষে মস্কোও ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আইএসবিরোধী লড়াইয়ে শামিল হয়। যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ বিরোধী গেরিলা দল ও তুরস্ক বিরোধী কুর্দী যোদ্ধাদের অস্ত্র ও আর্থিক সাহায্য দিয়ে আইএসের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে রাশিয়া প্রেসিডেন্ট আসাদের সমর্থনে আসাদ বিরোধী গেরিলা এবং আইএসের ওপর বোমাবর্ষন শুরু করে। এতে সিরিয়া পরিস্থিতিতে এক জঠিল সমীকরণের সৃষ্টি হয়। ২০১৪ সালে জানুয়ারি থেকে আইএসের হাতে কেবল ইরাকেরই ২৩ হাজার সাধারণ মানুষ প্রাণ হারান বলে জাতিসংঘের তথ্য। সিরিয়ায় তাদের ধ্বংসযজ্ঞের পুরো খতিয়ান জাতিসংঘের হাতে নেই। তবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষক গ্রুপ সিরিয়ান অবজারভেটরির তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালের মার্চ থেকে এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বহুপক্ষীয় সংঘর্ষে দেশটিতে অন্তত তিন লাখ লোক মারা পড়েছে, যার মধ্যে ৮৬ হাজার বেসামরিক নাগরিক। ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া ও মার্কিন বোমা হামলায় আইএসের ‘খিলাফত’ কিছুটা থমকে যায়। এরপর ইরাক ও সিরিয়ার বাইরেও হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় তারা। এক বছরের মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশের মুসলিম জঙ্গিরা আইএস নেতা বাগদাদির প্রতি সমর্থন জানায়। ২০১৬ সালে আইএস তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ হামলা চালায়; যাতে এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়। ধারণা করা হয়, ১৮টি দেশে সদস্য সংগ্রহ ও কার্যক্রম পরিচালনা করছে আইএস; এর মধ্যে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কাউন্টার টেররিজম সেন্টার বাংলাদেশ, মালি, সোমালিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপিন্সে আইএসের ‘সম্ভাব্য শাখা’র অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশ সরকার বরাবরই দেশের ভেতরে আইএসের অস্তিত্ব থাকার কথা নাকচ করে আসছে। কেবল ইরাক ও সিরিয়ার যোদ্ধারা নয়, এর বাইরে ৮৬টি দেশের অন্তত ২৭ হাজার বিদেশি যোদ্ধা আইএসের হয়ে লড়ছে বলে জানিয়েছে নিউ ইয়র্কভিত্তিক নিরাপত্তা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সৌফান গ্রুপ। এসব যোদ্ধার অর্ধেকেরও বেশি এসেছে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা থেকে। কালো বাজারে তেল বেচে পাওয়া অর্থই আইএসের খিলাফত ও যুদ্ধ পরিচালনার প্রাথমিক উৎস বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিবিসির প্রতিবেদনে। ২০১৩ সালের শুরু থেকেই গোষ্ঠীটি ইরাক ও সিরিয়ার বেশ কয়েকটি তেলের খনি নিজেদের কব্জায় নেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বিমান হামলার পর তাদের তেল অবকাঠামোর বিরাট ক্ষতি হয়। সেন্টার ফর দ্য অ্যানালিস্ট অব টেররিজম (সিএটি) এর ধারণা, খনি থেকে দ্রুত ও বেশি পরিমাণ তেল উত্তোলনের পর সেগুলোর সংস্কার ও তেল শোধনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আই এস এর হাতে নাই। এর বাইরে গতবছর ‘চাঁদাবাজি’ থেকে আয়ের ৩৩ শতাংশ তুলে আনে আইএস। চাঁদার এই অর্থ আগের বছরের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি বলে সিএটির তথ্য। দখল করা এলাকায় পানি ও বিদ্যুৎ বিল, উৎপাদিত পণ্যের উপর কর থেকেও আইএস আয় করে। দখলি এলাকার পরিমাণ একে একে হাতছাড়া হতে থাকায় এ আয়ের পরিমাণও কমছে, জানিয়েছে আইএইচএস কনফ্লিক্ট মনিটর। গত জুলাই মাসে হাফিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থের অভাবে আইএস এখন যুদ্ধ পরিচালনাতেও সমস্যায় পড়েছে। আইএসের আক্রমণ ও তাদের বিরুদ্ধে বিমান হামলার প্রতিক্রিয়ায় জনশূন্য হয়ে গেছে সিরিয়া ও ইরাকের অনেকগুলো শহর-গ্রাম। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী কেবল সিরিয়া থেকেই ৪৮ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছে। বেশিরভাগেরই গন্তব্য ছিল প্রতিবেশী তুরস্ক, লেবানন ও জর্ডান। ২০১৫ থেকে শরণার্থীদের এই স্রোত ইউরোপের দিকে ধাবিত হয়। সিরিয়ার শরণার্থীদের চাপ সামলাতে পরে তুরস্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে চুক্তি হয়। ওই চুক্তিতে শরণার্থীদের তুরস্কে রাখার বিনিময়ে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয় ইইউ। যুদ্ধে ৩০ লাখ ইরাকিও বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। মসুলে চলমান রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে এ সংখ্যা আরও ১০ লাখ বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা এই বিশ্ব সংস্থার। |
|
আইএস ও বাংলাদেশ | + |
বিশ্লেষকদের মতে, দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী এই ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম। এমনকি ভারত-পাকিস্তানের পর বাংলাদেশেও এর বিস্তার ঘটছে বলে দাবি করছে আন্তর্জাতিক মিডিয়া। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে এর প্রভাব নিয়ে চলছে আলোচনা। ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে আইএস-এর প্রতি কয়েক বাংলাদেশির আনুগত্য প্রকাশের একাধিক ভিডিও। অবশ্য আগেই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রবাসী বেশ কিছু তরুণের আইএস সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। সর্বশেষ বাংলাদেশে আসার পথে কলকাতায় চার আইএস সমর্থক ধরা পড়েছে বলে খবর প্রচার করেছে ভারতীয় মিডিয়া। বলা হয়ে থাকে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের নেটওয়ার্কে দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করছে এখন পর্যন্ত সৃষ্ট ইসলামী জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নৃশংসতা দেখিয়ে আবির্ভূত আইএস। বাংলাদেশে তারা কর্মী সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার মূলনীতির অনেক কিছুই দেশের জঙ্গি সংগঠন আনসারউল্লাহ বাংলা টিম ‘এবিটি’-এর কর্ম পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আল-কায়েদার কর্মকাণ্ড বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়া এবং একই সঙ্গে আল-কায়েদার চেয়ে অনেক বেশি আগ্রাসী সংগঠন ‘আইএস’-এর দিকে নজর পড়ে এবিটির। ইতিমধ্যেই এবিটির কর্মী সমর্থকরা নিজেদের মধ্যে এ বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ শুরু করেছে। একাধিক সূত্রে জানা যায়, গোয়েন্দা নজরদারি এড়িয়ে হিযবুত তাহরীরের অনেক সদস্য ‘আইএস’-এর আদর্শে উজ্জীবিত হতে আপাতত তাদের নিজেদের কর্মীদের মধ্যে শলাপরামর্শ শুরু করে দিয়েছে। ইরাকে সাম্প্রতিক সময়ে ‘আইএস’-এর কার্যক্রমে অনেক হিযবুত কর্মী দারুণ উজ্জীবিত। এক্ষেত্রে কৌশল হিসেবে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে ভাইভার, স্কাইপ, ওয়াটস আপ, টকএটোনসহ বিভিন্ন অ্যাপস। এ ছাড়া ফেসবুক, টুইটারেও এরা নিজেদের যোগাযোগ রক্ষা করছে। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) ব্যবহৃত পতাকা এবং ‘আইএস’-এর পতাকা একই। কেবল তাই নয়, কর্মকাণ্ডের ধরন এবং আদর্শগতভাবে এবিটির সঙ্গে দারুণ মিল রয়েছে আইএসের। দাওয়াহ, ইদাদ, রিবাত ও কিতাল এই চারটি স্তরে বিভক্ত হয়ে এবিটির সদস্যরা গোপনে প্রায় সারা দেশেই সক্রিয় রয়েছে। তবে বিশেষ করে ‘কিতালের’ দিকেই বিশেষ নজর থাকে এবিটির সদস্যদের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, র্যাবসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তীক্ষè নজরদারির কারণে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি), জেএমবিসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর কার্যক্রম সংকুচিত হয়ে পড়ে। তবে ২০০৯ সালের ১২ অক্টোবর হিযবুত তাহরীরের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও রোখা সম্ভব হয়নি হিযবুত কর্মীদের কার্যক্রম। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক মেধাবী ছাত্র এই সংগঠনে জড়িয়ে পড়ার কারণে বিভিন্ন কৌশলে তারা নিজেদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে। কাগজ-কলমে অনেকটা অহিংস নীতির কথা বলা হলেও সহিংস হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে হিযবুতের অনেক কর্মীদেরই প্রবল আগ্রহ বলে জানা গেছে। বিশেষ করে ইরাকে ‘আইএস’-এর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে হিযবুত কর্মীরা যারপরনাই উজ্জীবিত বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা সূত্র। এ বিষয়ে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আরো বেশি তৎপর হতে হবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। |
|
বিশ্বব্যাপী ইসলামী মৌলবাদী সংগঠনের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা |
+ |
|
সূত্র : উকিপিডিয়া, পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট