[ভূমিকা – সংজ্ঞা – পরিমাপ – আয়ু – উৎস – ব্যবহার – প্রভাব – প্রতিকার ও চিকিৎসা – শেষকথা]
ভূমিকা
‘তেজস্ক্রিয়তা’ শব্দটি বিজ্ঞানের বিষয় হলেও ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর এটি প্রথমবারের মত সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ‘তেজস্ক্রিয়তা’ এখন দৈনন্দিন বিজ্ঞানের অংশ। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে বেশিরভাগ আলোচনায় (পত্র-পত্রিকা, ব্লগ ও ফোরাম) তেজস্ক্রিয়তাকে কখনো অতিরঞ্জিত, কখনও অস্পষ্ট, আবার কখনও ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তেজস্ক্রিয়তাকে বুঝতে হলে বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার প্রয়োজন নেই, এর সম্পর্কে মৌলিক ধারণার জন্য প্রয়োজন একজন সচেতন নাগরিকের জানার ইচ্ছা ও আগ্রহ। ইদানীং বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক চুল্লীর ব্যবহারের কারণে তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়ে থাকে।
ফরাসি বিজ্ঞানী হেনরী বেকরেল ১৮৯৬ সালে গবেষনা করার সময় দেখতে পান যে, ইউরেনিয়াম ধাতুর নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফূর্ত-ভাবে বিশেষ ভেদন শক্তি সম্পন্ন রশ্মি অবিরত নির্গত হয়। তিনি আরো লক্ষ্য করেন যে, যে মৌল থেকে এই বিকিরণ নির্গত হয় তা একটি সম্পূর্ণ নতুন মৌলে রূপান্তরিত হয় এবং এটি একটি সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত নিউক্লিয় ঘটনা। তাঁর নামানুসারে এই রশ্মির নাম দেওয়া হয় “বেকরেল রশ্মি”। পরবর্তীকালে মাদাম কুরি ও তার স্বামী পিঁয়ারে কুরি ব্যাপক গবেষনা চালিয়ে দেখতে পান যে পোলোনিয়াম, রেডিয়াম, থোরিয়াম প্রভৃতি ভারী মৌলের নিউক্লিয়াস থেকেও “বেকরেল রশ্মি”-এর মত একই ধরনের রশ্মি নির্গত হয়। ১৮৯০ এর দশক থেকে ১৯০০ এর দশক পর্যন্ত হেনরী বেকরেল এবং মেরি কুরি ও পিয়রে কুরি পৃথকভবে তেজস্ক্রিয় পদার্থ আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে ১৯০৩ সালে এই তিন কিংবদন্তী তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের জন্য একত্রে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।
তেজস্ক্রিয়তা কী
তেজস্ক্রিয়তা বুঝার আগে মৌলিক পদার্থের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা দরকার। আমরা জানি, প্রত্যেক পদার্থ পরমাণু নামক অসংখ্য অতি ক্ষুদ্র কণা দ্বারা গঠিত। সব মৌলের পরমাণুতে থাকে ইলেকট্টন, প্রোটন এবং নিউট্রন – এই তিনটি মূল কণিকা। নিউট্রন ও প্রোটন পরমাণুর কেন্দ্র নিউক্লিয়াসে অবস্থান করে। ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের বাইরে অবস্থান করে। নিউট্রন চার্জবিহীন, পরমাণুতে নেগেটিভ ইলেকট্রন ও পজিটিভ প্রোটনের সংখ্যা সমান । তাই পরমাণু সামগ্রিকভাবে কোনরূপ চার্জযুক্ত থাকে না। একই মৌলের পরমাণুর কয়েক প্রকারের ভর হতে পারে (ভর = প্রোটন ও নিউট্রনের সর্বমোট সংখ্যা)। যে সব পরমাণুর প্রোটন সংখ্যা সমান কিন্তু ভর সংখ্যা ভিন্ন হয়, সে সব পরমাণুকে পরস্পরের আইসোটোপ বলা হয়। অর্থাৎ নিউট্রনের সংখ্যার তারতম্যের জন্যই আইসোটপের সৃষ্টি।
পরবর্তীতে দেখা গেছে যে, অস্থিতিশীল আইসোটোপগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন ধরনের রশ্নি বিকিরণ করে নিজের নিউক্লিয়াসে পরিবর্তন এনে অন্য মৌলের স্থিতিশীল আইসোটোপে পরিণত হয়। বিজ্ঞানী মেরি কুরি এসকল রশ্মির গতিপথ পরীক্ষা করে বৈশিষ্ট্য নিরূপন করেন। এরা আলফা, বিটা ও গামারশ্মি। অস্থিতিশীল মৌলের নিউক্লিয়াস হতে স্বত:স্ফূর্তভাবে অবিরত আলফা, বিটা ও গামা রশ্মির নির্গমন প্রক্রিয়াকে বলা হয় তেজস্ক্রিয়তা (radioactivity)। নির্গত এসব রশ্মিকে বলে তেজস্ক্রিয় রশ্মি (Radioactive rays)। তেজস্ক্রিয় মৌলগুলির নিউক্লিয়াসের ভেঙ্গে যাওয়ার ঘটনাকে তেজস্ক্রিয় বিঘটন (Radioactive decay) বলা হয়। যে সকল মৌল বা মৌলের আইসোটোপ তেজস্ক্রিয়তা ধর্ম প্রদর্শন করে তাকে তেজস্ক্রিয় মৌল বা তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ বলা হয়। যেমন ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম, কার্বন আইসোটোপ ইত্যাদি। তেজস্ক্রিয়তা সম্পূর্ণভাবে একটি নিউক্লিয় ঘটনা এবং একে চাপ তাপ, বিদ্যুৎ বা চৌম্বক ক্ষেত্রের মত বাইরের কোন ভৌত প্রক্রিয়া দ্বারা এর সক্রিয়তা হ্রাস বৃদ্ধি বা রোধ করা যায় না। যে সকল মৌলের পারমানবিক সংখ্যা ৮২ (82) অপেক্ষা বেশী, সাধারণতঃ সেই সকল মৌল তেজষ্ক্রিয় হয়।
উপরের চিত্রে কার্বনের তিনটি পরমাণু – প্রোটনের সংখ্যা একই, পার্থক্য শুধু নিউট্রনের, যথাক্রমে ৬, ৭ ও ৮। সুতরাং এগুলো কার্বনের আইসোটোপ। পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশের বেশিরভাগ কার্বনই কার্বন-১২। একই মৌলের সব আইসোটপের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম একই , তবে আচারব্যবহারে যথেষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন কার্বন -১৪ অস্থিত ও তেজস্ক্রিয়। আইসোটোপগুলো প্রাকৃতিক হতে পারে বা কৃত্রিমভাবেও প্রস্তুত করা যায়। আরো সহজ করে বলা যায়, তেজস্ক্রিয়তা (Radioactivity) হচ্ছে স্থিতিহীন পরমাণু (unstable atoms) থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্গত শক্তি। এই শক্তি ভরযুক্ত পার্টিকেল রশ্মি বা ভরবিহীন বিদ্যুৎচৌম্বকীয় রশ্মি উভয় ধরণের হয়। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ রশ্মি প্রধানত তিন ধরনের: আলফা বিটা ও গামা রশ্মি।
আলফা (α) কণাগুলো দু’টি নিউট্রন ও দু’টি প্রোটনের সমন্বয়ে গঠিত। তুলনামূলকভাবে এটি ভারী ও ধনাত্মক চার্জযুক্ত বিকিরণ। গঠনানুসারে একে হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস বলা যেতে পারে। আলফা বিকিরণ বায়ুর মধ্যে ২-৩ সেন্টিমিটারের বেশি যেতে পারে না। এমনকি সামান্য কাগজের বাধাও আলফা অতিক্রম করতে পারে না। তাই দুরত্বের দিক দিয়ে এটি মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। তবে আলফা বিকরিত হচ্চে এমন কোন বস্তু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে মারাত্মক ক্ষতি (যা অন্যান্য রশ্মি অপেক্ষা প্রায় ৩ থেকে ২০ গুণ বেশি) হওয়ার সম্ভাবণা থাকে।
বিটা (β) কণাগুলো খুবই হালকা যার ওজন প্রায় নেই বললেও চলে। চারিত্রিক বৈশিষ্টের দিক দিয়ে এগুলো ইলেকট্রনের মত। এরা প্রকৃতপক্ষে তীব্র গতিসম্পন্ন ইলেকট্রোন। বিটা কণাগুলো ঋণাত্মক চার্জযুক্ত এবং এদের ছেদন করার ক্ষমতা আলফা কণা থেকে ১০০০ গুণ বেশি। এরা বায়ুর মধ্যে কয়েক ফুট পর্যন্ত যেতে পারে এবং মানুষের ত্বকের বহিরাবরণ ভেদ করতে পারে। অতি মাত্রায় বিটা রশ্নির প্রভাবে চর্মরোগ জাতীয় সমস্যা দেখা দিতে পারে, এমনকি স্কীন ক্যান্সারও হতে পারে।
গামা (γ) রশ্নি কোন কণিকা নয়, এটি সাধারণ আলোকের ন্যায় তড়িৎ-চৌম্বক (electro-magnetic) তরঙ্গ। তাই এদের গতিবেগ সেকেন্ডে প্রায় ৩০০০০০ কিলোমিটার (১৮৬০০০ মাইল)। এদের ছেদন ক্ষমতা খুবই বেশি। এরা রঞ্জন রশ্মির ন্যায় বিভিন্ন পদার্থের মধ্য দিয়ে চলাচল করতে পারে। একমাত্র লিড বা কংক্রিটের তৈরি প্রশস্ত দেওয়াল দিয়েই গামা রশ্নিকে আটকে রাখা সম্ভব। এরা জীবন্ত কোষের ক্ষতি সাধন করে। তেজস্ক্রিয়তার ফলে বিস্তীর্ন এলাকায় জীব ও উদ্ভিদ জগতের উপর সুদুরপ্রসারী যে ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তারজন্য প্রধানতঃ এই গামা রশ্মিই দায়ী। তাছাড়া যে কোন পদার্থ গামা রশ্মি গ্রহণ করার পর অস্বাভাবিক কিছু কণা বিকিরন করে যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
মহাজাগতিক, গামা, রঞ্জন, অতিবেগুনি, দৃশ্যমান ও অবলোহিত রশ্মি এবং মাইক্রো, রেডিও ও টেলিভিশন তরঙ্গ প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় বিকিরনের তরঙ্গ। সবগুলো মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। এদের মূল পার্থক্য হচ্ছে তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য ও স্পন্দন সংখ্যায়। দৃশ্যমান আলো হল বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণ রশ্মির সামান্য অংশ মাত্র। সমগ্র বিকিরণ শক্তির অধিকাংশই অদৃশ্য।
তেজস্ক্রিয়তার পরিমাপ
কোন পদার্থের বিলিয়ন বিলিয়ন পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ কোন সুনিদির্ষ্ট তালে, একই সাথে বা একই গতিতে হয় না। সাধারণত গড়ে (প্রতি সেকেন্ড বা মিনিট) বিকিরণের সংখ্যা বা শক্তি ত্যাগের মাত্রা দিযে তেজস্ক্রিয়তার পরিমান নির্ধারণ করা হয়। তেজস্ক্রিয়তার পরিমাপ প্রকাশে বিভিন্ন একক ও মাত্রা ব্যবহার হয়। কারণ বিকিরণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনটি ধাপ: উৎস, বিকিরন বীম ও বিশোষিত হওয়া।
তেজস্ক্রিয়তা তথা বিকিরণের পরিমাপ তিন ধাপের (Radioactivity, Absorbed Dose, Effective dose) জন্য তিনভাবে করা হয়। পারমাণবিক চুল্লী ও তেজস্ক্রিয় মৌলের ব্যাপারে যখন বিকিরণের (Radiation) ব্যাপারটি আসে তখন দেখা হয় উৎস থেকে বিকিরণের পরিমাণ কত। এই পরিমাণকে বেকরেল বা ক্যুরি দিয়ে প্রকাশ করা হয়। প্রতি সেকেন্ডে একটি বিকিরণকে বলা হয় Becquerel। প্রতি সেকেন্ডে ৩৭,০০০,০০০,০০০ বিকিরণকে বলা হয় 1 curie (১ গ্রাম রেডিয়াম-২২৬ এক সেকেন্ডে ১ ক্যুরি বিকিরণ ত্যাগ করে)। উৎস থেকে দূরত্ব, মানুষের বয়স, শারীরিক কাঠামো, বিকিরণের গ্রেড, সময় ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে তেজস্ক্রিয়তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্তি ও বস্তু বিশেষে বিভিন্ন রকম হতে পারে। বিকিরণগুলো বিভিন্ন বস্তুতে কতটুকু শোষিত হল তা (Absorbed Dose ) প্রকাশের জন্য ব্যবহার হয় রেড (rad) বা গ্রে (gray)। যখন স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও পরিবেশ সংক্রান্ত ব্যাপার আসে তখন বিকিরণগুলো কতটুকু বিপজ্জনক অর্থ্যাৎ কোন বস্তু বা ব্যক্তি বিকিরণ (Absorbed Dose) শোষণ করার পর ক্ষতির (biological effects) পরিমাণ কতটুকু সেটাই (effective dose) পরিমাপ করা হয়। এই ডোসের পরিমাণকে রেম (rem) বা সিভার্ট (sievert)দিয়ে প্রকাশ করা হয়। মানুষের শরীরে শোষিত বিকিরণ যদি বিটা, গামা বা এক্স রশ্নির হয় তবে 1 gray = 1 dose = 1 sievert ধরা হয়। আর যদি আলফা রশ্নির হয় তবে 1 gray = 1 dose = 20 sievert ধরা হয়। অর্থ্যাৎ কোন মানুষের শরীর যদি বিটা/গামার এক গ্রে’র একটি ডোস ও আলফা রশ্মির একটি ডোস গ্রহণ করে তবে ক্ষতির পরিমাণ হিসেবে তা হবে ২১ সিভার্ট।
তেজস্ক্রিয়তা পরিমাপের ব্যাপারটিকে আরো ভালোভাবে বুঝার জন্য আমরা যদি বৃষ্টিকে বিকিরণ মনে করি এবং সেই বৃষ্টিতে যদি আমরা ভিজে যায় তাহলে বৃষ্টির পরিমাণকে বেকরেল(Bq), যতটুকু বৃষ্টি আমাদের শরীরে পড়ল তার পরিমাণকে গ্রে(Gy) এবং আমাদের শরীরের যতটুকু অংশ বৃষ্টিতে ভিজল তার মাপকে সিভার্ট(Sv) বলতে পারি।
রেম, রেড ও ক্যুরি পুরানো একক যা এখন খুব একটা ব্যবহার হয় না। The International System of Units (or SI units) : gray, sievert, and becquerel.
তুলনামূলক ধারণার জন্য এখানে একটি তালিকা তুলে ধরলাম:
1 curie = 3.7 x 1010 disintegrations per second
1 becquerel = 1 disintegration per second
1 millicurie (mCi) = 37 megabecquerels (MBq)
1 rad = 0.01 gray (Gy) = 10 mGy
1 rem = 0.01 sievert (Sv) = 10 mSv = 10000 μSv
1 gray (Gy) = 100 rad
1 sievert (Sv) = 100 rem
1 coulomb/kilogram (C/kg) = 3,880 roentgens
1 roentgen (R) = 0.000258 coulomb/kilogram (C/kg)
তেজস্ক্রিয়তার আয়ু
‘Half-life বা অর্ধ-জীবন’ শব্দটির সাথে বিজ্ঞানের ছাত্ররা পরিচিত হলেও সাধারণ মানুষের কাছে এটি অনেক সময় ভুল ধারণা সৃষ্টি করে। একটি তেজস্ক্রিয় মৌল থেকে কত বৎসর পর্যন্ত বিকিরণ হতে পারে তা জানতে হলে বিজ্ঞানের ভাষায় উল্লেখিত ‘Half-life বা অর্ধ-জীবন’-কে বুঝতে হবে। আমরা জানি, তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলো বিভিন্ন ধরনের রশ্নি বিকিরণ করে নিজের নিউক্লিয়াসে পরিবর্তন এনে অতেজস্ক্রিয় স্থিত পদার্থে পরিণত হয়। অর্থ্যাৎ সময়ের সাথে বিকিরণের ফলে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। যে কোন পরিমাণের তেজস্ক্রিয় পদার্থ তেজস্ক্রিয়-ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে পরিমাণের অর্ধেক হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সময়কে অর্ধ-জীবন বলা হয়। উদাহরণ হিসেবে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ কার্বন-১৪ এর গ্রাফটি দেখতে পারি:
যদি শুরুতে ১ গ্রাম কার্বন-১৪ থাকে তা তেজস্ক্রিয়-ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ০.৫ গ্রামে পরিণত হতে সময় লাগবে ৫৭৩০ বছর। উক্ত ০.৫ গ্রাম একইভাবে আবার ০.২৫ গ্রামে পরিণত হতে সময় লাগবে আরও ৫৭৩০ বছর। এই কারণে কার্বন-১৪ এর অর্ধ-জীবন = ৫৭৩০ বছর। এইভাবে ১ গ্রাম তেজক্রিয় কার্বন -১৪ সম্পুর্ণরূপে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে (বাস্তবে C-14 থেকে N-14 এ পরিণত হতে) সময় লাগবে প্রায় ৫২০০০ বছর। অনেকের কাছে মনে হতে পারে অর্ধ-জীবন = ৫৭৩০ বছর হলে পূর্ণ-জীবন = ১১৪৬০ বছর! ভুল! বিজ্ঞানীদের মতে তেজস্ক্রিয় বস্তুর সবটুকু বিক্রিয়া করার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের ধারণাটি অর্থহীন, কারণ বিক্রিয়াটি অত্যন্ত ধীর গতিতে চলে এবং যখন বস্তুর কেবল অল্প পরিমাণ বাকী থাকে তখন তত্তীয়ভাবে সে বিক্রিয়া শেষ হতে অনির্দিষ্ট কালের প্রয়োজন হবে।
পরিচিত কিছু আইসোটোপের অর্ধ-জীবনের তালিকা:
নাইট্রোজেন-১৬ : ৭ সেকেন্ড
আয়োডিন-১৩১ : ৮ দিন
ফসফরাস-৩২ : ১৪ দিন
সিসিয়াম-১৩৭ : ৩০ বছর
প্লুটোনিয়াম-২৩৯ : ২৪১০০ বছর
ইউরেনিয়াম-২৩৫ : ৭০৪ মিলিয়ন বছর
পটাশিয়াম-৪০ : ১.৩ বিলিয়ন বছর
রুবিডিয়াম-৮৭ : ৪৯ বিলিয়ন বছর
তেজস্ক্রিয়তার উৎস
তেজস্ক্রিয়তার উৎসকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়: ১। প্রাকৃতিক, ২। মানুষের সৃষ্ট ও ৩। পারিপার্শ্বিক পরিবেশগত।
১। প্রাকৃতিক উৎস: পৃথিবীর সবদিকে মহাশূন্য থেকে ইলেকট্রন, প্রোটন ও কয়েকটি পরমাণুর নিউক্লিয়াস প্রায় আলোর বেগে পৃথিবীতে আঘাত হানে। এদেরকে মহাজাগতিক রশ্মি (Cosmic rays) বলে। এই রশ্মিগুলো বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত এবং অল্প মাত্রায় বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে চলে আসে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা যত বেশি হয়, এর মাত্রা ততই বাড়তে থাকে। পার্থিব বিকিরণ অর্থ্যাৎ পৃথিবী এবং তার বায়ুমন্ডল থেকে উদ্ভুত বিদ্যুৎ-চৌম্বক বিকিরণও তেজস্ক্রিয়তার একটি উৎস। পৃথিবী সৃষ্টির সময় যেসব তেজস্ক্রিয় মৌল বিদ্যমান ছিল তার কিছু পরিমাণ এখনো আছে। কারণ এদের জীবনকাল খুবই দীর্ঘ। যেমন K-40, U-238 and Th-232 ইত্যাদি। প্রাকৃতিক উৎসের মধ্যে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ হচ্ছে রেডন গ্যাস। এটি বাতাস থেকে ৮ গুণ ভারী। এর তিনটি প্রাকৃতিক আইসোটোপ রয়েছে। এগুলো রেডিয়াম, ইউরানিয়াম ও থোরিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা থেকে সৃষ্টি হয়। এছাড়া প্রাকৃতিক শিলা, উদ্ভিদ, প্রাণী ও বিভিন্ন শিল্প থেকে প্রচুর রেডিয়ান গ্যাস বায়ুমন্ডলে যোগ হয়। সাধারণভাবে একজন মানুষ বছরে তিন মিলি সিভার্ট প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার সম্মুখীন হয়।
২। মানুষের সৃষ্ট: মানুষের সৃষ্ট তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বিভিন্ন রকমের হয়। চিকিৎসায় এক্স-রে ও অন্যান্য বিকিরণ থেরাপির মেশিন তেজস্ক্রিয়তার উল্লেখযোগ্য উৎস। শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি ও দ্রব্যের মান যাচাইয়ের জন্য বিভিন্ন কমপোনেন্ট ব্যবহার হয় যেগুলো থেকে বিপজ্জনক বিরণের সৃষ্টি হয়। নিউক্লিয়ার চুল্লী এবং যেসব পারমাণবিক মারণাস্ত্র জনবিরল এলাকায় পরীক্ষা-নিরিক্ষা করা হয় সেখান থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয়তা বিরাট এলাকার মানুষের জন্য বিপজ্জনক। এছাড়া পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুল্লী থেকে বিভিন্ন দূর্ঘটনায় (চেরনোভিল ও ফুকুশিমা)বিপুল পরিমানে তেজস্ক্রিয় পদার্থ আশেপাশের বিরাট এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
৩। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ: আমাদের আশেপাশের প্রায় প্রত্যেক বস্তু থেকেই কমবেশি বিকিরণ হচ্ছে। আমাদের বাড়িঘর, খাদ্য, পানীয় এমনকি আমাদের নিজের শরীর থেকেও তেজস্ক্রিয় রশ্মির বিকিরণ হচ্ছে।
dose
এই বিকিরণ খুবই কম মাত্রার যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর ভিত্তি করে এর হার কমবেশি হতে পারে। যেমন ইট-পাথরের তৈরি ঘরের বিকিরণের মাত্রা কাঠের ঘরের চেয়ে বেশি।
তেজস্ক্রিয়তার ব্যবহার
গত কয়েক দশক ধরে মানুষ বিজ্ঞানের পারমাণবিক শাখায় যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেছে। বিভিন্ন প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছে অনেক কৃত্রিম আইসোটোপ। পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে, জটিল চিকিৎসায় এবং শিল্প-কারখানায় পারমাণবিক শক্তি তথা এইসব বিকিরণকে কাজে লাগানো হচ্ছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ থেকে ফিশন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত তাপ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে টারবাইন ও জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
রেডিও থেরাফিতে গামা রশ্মি দিয়ে ক্যান্সার-সেলের মৃত্যু ঘটিয়ে ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা করা হয়। এক্স-রে, মেমোগ্রাফি, এনজিওগ্রাফি প্রভৃতি পদ্ধতিতে বিকিরণ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। ঔষধ ও ডাক্তারী যন্ত্রপাতিকে জীবানুমুক্ত করতে তেজস্ক্রিয় বস্তু ব্যবহার করা হয়। এইডস, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জঠিল রোগের গবেষণার ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয় বস্তুর ব্যবহার হচ্ছে।
নির্মাণ বা উৎপাদন-শিল্পে কাগজ, প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি বিভিন্ন বস্তুর পুরুত্ব, ঘনত্ব ও উপাদানের সঠিক পরিমাণ নির্ণয়ে আলফা ও বিটা রশ্মিকে ব্যবহার করা হয়। অতি সামান্য পরিমাণ তেজস্ক্রিয় বস্তু ব্যবহার করে পাইপলাইনের মধ্য দিয়ে পরিচালিত তরল বা গ্যাসীয় পদার্থের গতি ও ভূ-গর্ভস্থ পাইপ লাইনে কোন ফাটল সৃষ্টি হলে তা মাটির উপরিভাগ থেকেই নির্ণয় করা যায়। অন্ধকারে দৃশ্যমান করতে ঘড়ির কাঁটা ও নম্বরে তেজষ্ক্রিয় থোরিয়ামের সাথে জিঙ্ক সালফাইড মিশিয়ে প্রলেপ দেওয়া হয়।
খাদ্যশস্যের মান উন্নয়ন, সংরক্ষণ, পুষ্টিগুণ বর্ধিতকরণ এবং কীটপতঙ্গ দমনে তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করা হয়। জেনেটিক পরিবর্তন ঘটিয়ে অধিক ফলনশীল, বৈরী আবহাওয়ায় খাপ খাওয়াতে সক্ষম ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ প্রতিরোধক শস্য উৎপাদনে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ প্রয়োগ করা হয়। মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন অল্প পরিমাণে তেজস্ক্রিয় বস্তু ব্যবহার করে মাটি, পানি বা বায়ুর দূষণমাত্রা নির্ণয় করা সম্ভব। সাবমেরিন ও মনুষ্যবিহীন মহাশূন্যযানে জ্বালানির উৎস হিসেবে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার হয়।
কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে (তেজস্ক্রিয়তা-ক্ষয়ের পরিমাপ) বিশ্লেষণ করে জীবাশ্মসংক্রান্ত নমুনা ও শিলাখন্ডের বয়স নির্ধারণ, উদ্ভিদের অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক ও জৈবিক প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ, চিত্রকর্ম বা অন্যান্য শিল্পকর্মের খাঁটিত্ব প্রমাণ এবং খনিজ পদার্থের ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ সম্ভব হয়। নিরাপত্তার জন্য স্ক্যানিং মাশিনে ও স্মোকিং ডিটেকটরে তেজস্ক্রিয় পদার্থের রশ্মিকে ব্যবহার করা হয়।
জীবজগতের উপর তেজস্ক্রিয়তার প্রতিক্রিয়া
অল্প মাত্রার তেজস্ক্রিয়তা আমাদের কোন ক্ষতি করে না। কারণ আমাদের শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। এছাড়া আমাদের শরীরের কোন কোষ আঘাতপ্রাপ্ত হলে অনেক ক্ষেত্রেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সুস্থ হয়ে উঠে, কোষের মৃত্যু হলে আবার বায়োলোজিক্যাল প্রসেসে নতুন কোষের সৃষ্টি হচ্ছে। কত মাত্রা থেকে তেজস্ক্রিয়তা মানুষের জন্য ক্ষতিকর তা একদম সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না। কারণ তা একেকজনের জন্য একেক রকম হতে পারে। মানুষের উপর তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব ও মাত্রা তিনটি পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে: তেজস্ক্রিয়তা এলাকায় অবস্থানকালীন সময়, তেজস্ক্রিয়তার উৎস থেকে দুরত্ব এবং প্রতিরোধক ব্যবস্থা। এখনও পর্যন্ত কোনো নিরাপদ-মাত্রা আবিস্কৃত বা স্বীকৃত হয়নি, কারণ বিভিন্ন ব্যক্তির সহন-মাত্রা বিভিন্নরকম। তবে সাধারণভাবে কোনো মানুষের একবারে ১ (এক) মিলি-সিভার্ট-এর বেশি রেডিয়েশন গ্রহণ নয় বলেই মনে করা হয়।।
স্বাভাবিকভাবে একবার X-ray-তে যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা নির্গত হয় তার পরিমাণ ২০ মাইক্রো-সিয়েভার্ট। সাধারণভাবে বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন থেরাপীতে তেজস্ক্রিয়তার যে মাত্রা ব্যবহার করা হয়, তা প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার তুলনায় অনেক বেশি। একবার এক্স-রে করালে একটা মানুষ যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসে, তা প্রায় ১০ দিনের প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার সমান, যার কার্যকর মাত্রা প্রায় ০.১ মিলি সিভার্ট। কিডনি ও মূত্রাশয় পরীক্ষার জন্য আইভিপি বা ইন্ট্র্রাভেনাস পাইলোগ্রাম পরীক্ষায় ব্যবহূত তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ এক বছরের প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার সমান।
মানবদেহে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব
সকল তেজস্ত্রিয় পদার্থের প্রতিক্রিয়া সমান নয়। অতিরিক্ত মাত্রার তেজস্ক্রিয় পদার্থ শরীরে প্রবেশ করলে বা স্পর্শে এলে আমরা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সম্মুক্ষীণ হতে পারি। তেজস্ক্রিয় রশ্মি মানুষের সংস্পর্শে এলে শরীরের জীবিত কোষ ধ্বংস হয় কিংবা কোষের মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণের সৃষ্টি হয়। আলফা ও বিটা রশ্মি শরীরের বাহ্যিক অংশে এবং গামা রশ্মি কোষের গঠনের ওপর প্রতিক্রিয়া করে। বিকিরণের পরিমাণ সামান্য হলেও এতে বেশি সময় অবস্থানের ফলে তা মানুষের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আবার বিকিরণের পরিমাণ একটু বেশি হলেও এতে অল্প সময় অবস্থানের ফলে তা মানুষের জন্য ক্ষতিকর নাও হতে পারে। তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে ক্যানসার ও লিকোমিয়া রোগের সম্ভাবনা বেশি। তাছাড়া নবজাতক ও শিশুদের শারীরিক ও মানসিক পঙ্গুত্বের জন্যও তেজস্ক্রিয়তা অনেকাংশে দায়ী। আমাদের মানবদেহে একদিনে বিভিন্ন মাত্রার তেজস্ক্রিয়তা গ্রহণের ফলে অসংখ্য প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এটা যদিও শারীরিক সক্ষমতার উপর ভিন্ন ভিন্ন হয় তবুও সাধারণ সক্ষমতার হিসেবে আনুমানিক ধারনার জন্য নিচের দু’টি তালিকা গ্রহণ করা যেতে পারে।
সিভার্ট একক হিসেবে একদিনে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা গ্রহণের ফলে যে-সব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে:
১। মাত্রা 0 – 0.25 Sv (0 – 250 mSv) পর্যন্তঃ সম্পূর্ণ নিরাপদ, কারো কিছু হবে না।
২। মাত্রা 0.25 – 1 Sv (250 – 1000 mSv) পর্যন্তঃ শারীরিকভাবে যারা দুর্বল তাদের কারো কারো খাবারে অরুচী, বমি বমি ভাব, ক্ষুধা-মন্দা দেখা দেবে। কারো অস্থি-মজ্জায় বা লাসিকা-গ্রন্থিতে বা শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যাথা-ব্যদনা বা বিষন্নতা ও অস্বাভাবিকতা দেখা যেতে পারে।
৩। মাত্রা 1 – 3 Sv (1000 – 3000 mSv) পর্যন্তঃ খাবারে অরুচী আসবে, বমি বমি ভাব হবে, ক্ষুধা-মন্দা দেখা দেবে, শরীরে গোটা-খোঁচ-পাঁচরা-ঘা সৃষ্টি হবে, অস্থি-মজ্জায় বা লাসিকা-গ্রন্থিতে বা শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যাথা-বেদনা, বিষন্নতা ও অস্বাভাবিকতা অনুভূত হবে। যথাসময়ে চিকিৎসা করলে এগুলো থেকে প্রায় সব-ক্ষেত্রেই সুস্থ হওয়া যায়।
৪। মাত্রা 3 – 6 Sv (3000 – 6000 mSv) পর্যন্তঃ প্রচুর বমি ও ক্ষুধা-মন্দা হবে। রক্ত-ক্ষরণ, ঘা, ডায়রিয়া, বিভিন্ন প্রকার চর্ম-রোগ ও চামড়ায় পোড়া দাগ দেখা দেবে। সাথে সাথে চিকিৎসা না করা হলে মৃত্যু অনিবার্য।
৫। মাত্রা 6 – 10 Sv (6000 – 10000 mSv) পর্যন্তঃ উপরের উপসর্গগুলো দেখা দেবার সাথে সাথে স্নায়ু-তন্ত্র বিকল হয়ে পড়বে। কিছু সময়ের মধ্যেই মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা।
৬। মাত্রা 10 Sv (10000 mSv) হতে অধিকঃ শারীরিক অসাড়তা এবং অবশ্যম্ভাবি মৃত্যু।
তেজস্ক্রিয়তার প্রতিকার ও চিকিৎসা
আগেই বলেছি, বিকিরণের পরিমাণ সামান্য হলেও এতে বেশি সময় অবস্থানের ফলে মানুষের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আবার বিকিরণের পরিমাণ একটু বেশি হলেও এতে অল্প সময় অবস্থানের ফলে তা মানুষের জন্য ক্ষতিকর নাও হতে পারে। প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত বিকিরণকে এড়িয়ে চলা প্রায় অসম্ভব। একটু সচেতন হলে মানুষ-সৃষ্ট বিকিরণকে কিছুটা এড়িয়ে চলা প্রায় সম্ভব। নিজেদের উপর তেজস্ক্রীয়তার ক্ষতিকর মাত্রা কমাতে হলে তিনটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে হবে: সময়, দূরত্ব এবং সংরক্ষণমূলক আবরণ।
Minimize Exposure Time to Minimize Dose
Maximize Distance to Minimize Dose
Maximize Shielding to Minimize Dose
ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে আত্মরক্ষার্থে আমাদের করণীয়:
১। প্রখর সূর্যকিরণে (দুপুর ১২ – ২টা) বাহিরে যাওয়া থেকে বিরত থাকা।
২। যতটুকু সম্ভব বৃষ্টির পানিকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা।
৩। ক্লোরোফিল ও অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করা।
৪। খাবারে আয়োডিন ব্যবহার করা (আয়োডিনযুক্ত লবণ)।
৫। দিনের বেলায় বাহিরে বের হলে সান-গ্লাস ব্যবহার করা।
৬। বিভিন্ন রেডিয়েশন থেরাপি অতিমাত্রায় গ্রহণ না করা।
৭। এক্স-রে ও রেডিয়েশন হয় এমন সব মেশিন থেকে দূরে থাকা।
৮। দিনের বেলায় বাহিরে বের হলে শরীর ঢেকে রাখা বা সান-লোশন বা ক্রিম ব্যবহার করা।
৯।দৈনন্দিন জীবনে গৃহস্থালি কাজে যেসব রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করি তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতনতা।
১০। ল্যাবরেটরি ও শিল্প-কারখানার কর্মস্থলে রেডিয়েশন ডিটেকটর ডিভাইস ব্যবহার করা।
১১।কৃত্রিমভাবে রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে যেসব ফলমূল পাকানো ও বাজারজাত করা হয় তা কম খাওয়ার চেষ্টা করা।
তেজস্ক্রিয়তার নিম্নতম ক্ষতিকর মাত্রা নির্ধারন করা সম্ভব না হলেও আলোচনার সুবিথার্থে এখনও পর্যন্ত মানুষের তেজস্ক্রিয়তা গ্রহণের নিরাপদমাত্রা ১ (এক) মিলি-সিভার্ট ধরা হয়। যাই হোক, তেজস্ক্রীয়তার কারণে উল্লেখিত রেডিয়েশন সিকনেসের কোন লক্ষন দেখা গেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগীকে তেজস্ক্রীয় এলাকা থেকে সরিয়ে নিতে হবে। কাপড়চোপড় পরিবর্তন করে বিকিরণ কমাতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
শেষকথা
বিশ্ব-জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার ও ভেজাল খাদ্যের কারণে আমরা যেসব দূরারোগ্যের শিকার হচ্ছি তারমধ্যে ক্যান্সার অন্যতম। সুতরাং জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে আমরা যে তেজস্ক্রিয়তার স্বীকার হচ্ছি তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ক্যান্সার একটি দুরারোগ্যে ব্যাধি। তাছাড়া এর চিকিৎসা খুবই জটিল ও ব্যয়বহুল। তেজস্ক্রিয়তাকে সম্পূর্ণভাবে এড়ানো সম্ভব না হলেও একটু সাবধান হলে এর মাত্রাকে আমরা অনেক কমিয়ে আনতে পারি। ক্যান্সারসহ যাবতীয় রেডিয়েশন সিকনেস থেকে বাচঁতে হলে চিকিৎসার আগে প্রয়োজন সচেতনতা ও প্রতিকার।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
উইকিপিডিয়া
দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা
ইন্টারনেট