দক্ষিণ কোরিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যকার তিন বছরের অধিক সময় ব্যাপী (২৫ জুন ১৯৫০ – ২৭ জুলাই ১৯৫৩) সংঘটিত হওয়া একটি আঞ্চলিক সামরিক যুদ্ধ ইতিহাসে কোরীয় যুদ্ধ নামে পরিচিত। উ: কোরিয়ার পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এবং দ: কোরিয়ার পক্ষে জাতিসংঘের সন্মতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য কয়েকটি দেশ প্রত্যক্ষভাবে এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। ১৯৫৩ সালে কোরীয় যুদ্ধ শেষ হলেও এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো চুক্তি হয়নি। জাতিসংঘ বাহিনীর পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর কোরীয় সেনাবাহিনী ও চীনের মধ্যে স্বাক্ষরিত অস্ত্রবিরতি চুক্তির মাধ্যমে ওই যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই যুদ্ধে আড়াই থেকে তিন মিলিয়ন মানুষ হতাহত হয়েছিল।
এক নজরে কোরিয়ার যুদ্ধ
কখন
২৫ জুন, ১৯৫০ থেকে ২৭ জুলাই, ১৯৫৩
কোথায়
কোরিয়ান উপদ্বীপ (দক্ষিণ কোরিয়া ও উত্তর কোরিয়া)
প্রতিপক্ষ
উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম ইল-সাং-এর নির্দেশে কমউিনিস্ট বাহিনী North Korean People’s Army (KPA) দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করলে যুদ্ধের শুরু হয়। পরে উ: কোরিয়ার সা্থে যোগ দেয় চীন ও রাশিয়া।
অন্য পক্ষে দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনী South Korean Republic of Korea Army (ROK) এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত বিভিন্ন দেশের সেনাসদস্য।
সর্বমোট অংশগ্রহণকারী সৈন্য
দক্ষিণ কোরিয়া ও জাতিসংঘ: ৯৭২,২১৪
উ: কোরিয়া, চীন, সোভিয়েত: ১,৬৪২,০০০
যুদ্ধে কে জিতেছিল
সত্যিকার অর্থে কোনো পক্ষই এই যুদ্ধে জিতে নাই। যদিও কোরিয়ার যুদ্ধের রেশ এখনও বয়ে চলেছে। তবে দুই দেশ এই মর্মে সন্মত হয়েছিল যে পূর্ববর্তী সীমান্তরেখা অর্থাৎ ৩৮ অক্ষরেখা বরাবর একটি বেসামরিক জোন demilitarized zone (DMZ) থাকবে যার দুই পাশে নিজ নিজ দেশের সীমান্তবাহিনী অবস্থান করবে।
সর্বমোট প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি
দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য : ১৭৮,২৩৬ জন নিহত, ৩২,৮৪৪ জন নিঁখোজ, ৫৬৬,৩১৪ জন আহত।
উ: কোরিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সৈন্য : নিহত ৪ থেকে ৫ লাখ, ১৫২,০০০ জন নিঁখোজ, প্রায় ৭ লাখ জন আহত।
উ: ও দ: কোরিয়ার মোট নিহত ও আহতের সংখ্যা প্রায় আড়াই মিলিয়ন।
যুদ্ধের কারণ
যুক্তরাষ্ট্র ও একসময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তির প্রতিযোগিতা ও রাজনৈতিক মতানৈক্য তথা স্নায়ুযুদ্ধের কৌশলগত ভারসাম্যের বলি হিসেবে বিভক্ত হয়েছিল বিশ্ব। জার্মানি যেমন বিভক্ত হয় তেমনি বিভক্ত হয় কোরীয় উপদ্বীপ– উত্তর কোরিয়া অফিসিয়ালি গণতান্ত্রিক জনপ্রজাতান্ত্রিক কোরিয়া—DPRK এবং দক্ষিণ কোরিয়া রিপাবলিক অফ কোরিয়া—ROK বলে পরিচিত। স্নায়ুযুদ্ধ বা শীতল যুদ্ধ (Cold War) শেষ হওয়ার পর সময়ের দাবি ও পরিবর্তনের হাওয়ায় এর অনেক ক্ষতই শুকিয়েছে। একমাত্র কোরীয় উপদ্বীপকেই এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে সেই যুদ্ধের দগদগে ঘা। ১৯৪৮ সালে উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত দুই কোরিয়া এখনও দুই পথেই হাঁটছে।
কোরিয়া যুদ্ধের কিছু ছবি
ঐতিহাসিক পটভূমি
১৯১০ থেকে ১৯৪৫ সাল অবধি কোরিয় উপদ্বীপটি ছিল জাপান-নিয়ন্ত্রিত। জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবিভক্ত কোরিয়া লড়াই করেছিল। ২য় মহাযুদ্ধের সময় জাপান কোরিয় উপদ্বীপটিতে তার দখলদারিত্ব বজায় রেখেছিল। যুদ্ধের পর পরাজিত জাপানি সৈন্যরা কোরিয় উপদ্বীপ ত্যাগ করে। ২য় মহাযুদ্ধের পর সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই কোরিয়া উপদ্বীপ দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। উত্তর দিক থেকে সোভিয়েত রুশ এবং দক্ষিণ দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অগ্রসর হয়। কোরিয়াকে মোটামুটি মাঝামাঝি জায়গায় অর্থাৎ ৩৮ অক্ষরেখা বরাবর দুইভাগে বিভক্ত করে দুই পরাশক্তির তাদের আওতায় নিয়ে যায়। কিম ইল সুং ছিলেন সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণার বিশ্বাসী। তিনি আগে থেকেই জাপানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন। সোভিয়েতরা তাঁকে সমর্থন করে। পরবর্তীকালে কিম ইল সুং এর নেতৃত্বে উত্তর কোরিয়া সমাজতান্ত্রিক বিনিমার্ণের দিকে ঝুঁকেছিল। অন্যদিকে ওই একই সময়ে মার্কিন সাহায্যপুষ্ট জাতীয়তাবাদীরা কোরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে বামপন্থি আন্দোলন দমন করে। স্নিনমান রি ছিলেন জাতীয়তাবাদী নেতা, তিনিও জাপানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে সমর্থন দেয়। আপাত বিভক্ত কোরিয়াকে একত্রিকরণের বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু মার্কিনীরা চায় পুরো কোরিয়া তাদের প্রভাববলয়ে একত্রিত থাকুক। অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন চায় যে, কোরিয়া উপদ্বীপ যেহেতু বাড়ির কাছে সুতরাং সেটি তাদের ভাবাদর্শে ঐক্যবদ্ধ থাকুক। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫০ সালের ২৫ জুন পর্যন্ত এই টানাপড়েন চলতে থাকে।
এই আপাতস্থিতিশীলতার ব্যাঘাত ঘটায় সমাজতান্ত্রিক জোট। আকস্মিকভাবে উত্তর কোরিয়া আক্রমণ করে দক্ষিণ কোরিয়াকে। এর পশ্চাতে থাকে সোভিয়েত এবং চীন। দক্ষিণ কোরিয়ার এই বিপদে এগিয়ে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পাশ্চাত্য জোট। উত্তর কোরিয়া ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ প্রায় পুরো দক্ষিণ কোরিয়া দখল করে নেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগতভাবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে ‘দক্ষিণ কোরিয়ার সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা’ রক্ষায় নামেমাত্র আরো কয়েকটি দেশকে সাথে নিয়ে বিধিসম্মতভাবে অগ্রসর হয়। ১৯৫০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জেনারেল ম্যাগ আর্থারের নেতৃত্বে মার্কিন এবং দক্ষিণ কোরীয় সামরিক বাহিনী যৌথ পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। অক্টোবর নাগাদ জাতিসংঘ বাহিনী নর্থ কোরীয় বাহিনীকে ইয়োলো নদী পর্যন্ত হটিয়ে দেয়। ইয়োলো রিভার হচ্ছে চীন-কোরিয়া সীমান্ত নির্ধারক। অবস্থা বেগতিক দেখে চীনা সেনাবাহিনী উত্তর কোরীয়দের সাথে যোগ দেয়। এতদ সত্ত্বেও উত্তর কোরীয় বাহিনী পিছু হঁটে সেই আগের ৩৮ অক্ষাংশে ফিরে আসে।
North Korean, Chinese and Soviet Union (red)
South Korean, US and United Nations forces (green)
ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ কারণে ম্যাগ আর্থারের স্থলাভিষিক্ত হন জেনারেল এম.বি.রিগওয়ে। তিনি শান্তি উদ্যোগ শুরু করেন। জটিল কূটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী আলাপ-আলোচনা অবশেষে ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই যুদ্ধ-বিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। উভয়পক্ষ সেনাবাহিনীর সর্বশেষ দখলরেখাকে যুদ্ধ-বিরতি রেখা বলে মেনে নেয়। সেই থেকে আজঅবধি বিভক্ত কোরিয়া স্ব স্ব ভৌগোলিক সীমানা মেনে নিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিরাজমান রয়েছে। যুদ্ধমান পক্ষ দুটোর বিপরীত ভাবাদর্শ অনুযায়ী উভয় কোরিয়া শাসিত হতে থাকে।
যুদ্ধোত্তর কোরিয়া
পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভাবাদর্শে পরিচালিত দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল
পুঁজিবাদী অর্থনীতির কারণে দক্ষিণ কোরিয়া অভাবনীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করে। বর্তমানে বাজার অর্থনীতির দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্বের জিডিপি-দিক থেকে অবস্থান পঞ্চদশতম। জি-টোয়েনটির অন্যতম শরীক রাষ্ট্রটি ষাটের দশক থেকেই দ্রুত বর্ধনশীল দেশে পরিনত হয়েছিল। রপ্তানী নির্ভর দেশটি ২০০৯ সালে অষ্টম বৃহৎ রপ্তানীকারক দেশের স্বীকৃতি লাভ করেছে।
সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভাবাদর্শে পরিচালিত উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়াং
উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান কিম ইল সুঙ সমাজতান্ত্রিক কোরিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। উত্তর কোরিয়ার বিপুল খনিজ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও সীমাবদ্ধ উন্নয়ন কৌশলের কারণে দেশটি অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়। ১৯৫৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার জিডিপি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) ছিল আফ্রিকার দরিদ্রতম রাষ্ট্র ঘানারও নীচে। ২০০৮ সালে যা হয়ে ওঠে ঘানার চেয়ে ১৭ ভাগ বেশি। দেশজুড়ে অনাহার সত্ত্বেও উত্তর কোরিয়া একাধিকবার পারমানবিক অস্ত্র পরীক্ষা করে। ‘কিম ডাইনেস্টির’ শাসনে দুনিয়াবিচ্ছিন্ন উত্তর কোরিয়া টিকে থাকার বিস্ময়কর ক্ষমতার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পারমাণবিক হুমকি দেখিয়ে যাচ্ছে। আর দক্ষিণ কোরিয়া অর্জন করেছে চমকে দেওয়ার মতো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। মাথাপিছু ৩০ হাজার ডলারের বেশি আয় নিয়ে বিশ্ব জিডিপির সূচকে দেশটির স্থান এখন ১৫ নম্বরে। পারমাণবিক সক্ষমতা বাদ দিলে সামরিক শক্তিতেও দেশটি এখন সামনের কাতারে, বিশ্বের মধ্যে নবম। ইসরায়েল ও জাপানের মতো দেশ থেকেও এগিয়ে।
উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি (১৯৪৭ – ২০১৬)
১৯৪৭ – নির্বাচনের মাধ্যমে সমগ্র কোরিয়ায় একটি অস্থায়ী সরকার নির্বাচন করতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধিতা।
১৯৪৮ – জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ কোরিয়ায় নির্বাচনে Syngman Rhee প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত এবং স্বাধীন রিপাবলিক অফ কোরিয়া সরকার স্থাপন। উত্তর কোরিয়ার এতে অংশ নিতে অস্বীকার। উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির কোরিয়া গণতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্রী প্রতিষ্ঠা।
১৯৫০ – কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়ার পিপলস আর্মির (NKPA) 135,000 সৈন্যের 38th সমান্তরাল ক্রস ও কোরিয়া প্রজাতন্ত্র (দক্ষিণ কোরিয়া) আক্রমণ। দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে অংশগ্রহণ করতে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের নির্দেশ। কোরিয়া যুদ্ধ শুরু। উত্তর কোরিয়ার পক্ষে চীনের সেনাবাহিনীর কোরিয়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ।
১৯৫৩ – উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে কোরিয়া যুদ্ধের সমাপ্তি। যুদ্ধবিরতি শর্তাদি অসামরিকীকৃত এলাকা, পূর্ববর্তী সীমান্তরেখা অর্থাৎ ৩৮ অক্ষরেখা বরাবর একটি বেসামরিক জোন demilitarized zone (DMZ) থাকবে যার দুই পাশে নিজ নিজ দেশের সীমান্তবাহিনী অবস্থান করবে।
১৯৬৮ – দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক চাং হিকে হত্যার উদ্দেশ্যে রাজধানী সিউলে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ব্লু হাউসে উত্তর কোরিয়ার একদল কমান্ডোর হামলা। কিন্তু প্রাসাদের মাত্র ৮০০ মিটার দূরে ওই কমান্ডো দলের ৩২ সদস্যকে আটকে দেওয়া হয়। পরে তাঁদের আটক ও হত্যা করা হয়।
১৯৬৮ – উত্তর কোরিয়া USS Pueblo নামে একটি মার্কিন নৌ গোয়েন্দা জাহাজ দখল করে নেয়।
১৯৭২ – শান্তিপূর্ণ পুনএকত্রীকরণের উপর উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ বিবৃতি।
১৯৭৪ – উ: কোরীয় নেতা কিম ইল-গাওয়া তার উত্তরাধিকারী হিসেবে জ্যেষ্ঠ পুত্র কিম জং-ইলকে মনোনীত করেন।
১৯৮০ : দক্ষিণ কোরিয়ার গবাঙ্জু শহরে ভিন্নমতাবলম্বী ও আর্মড ফোর্সের (18-27 মে) মধ্যে রণক্ষেত্র পরিণত হয়. হতাহতের সংখ্যা প্রায় ৫০০। সারা দেশে মার্শাল ল ঘোষিত হয়।
১৯৮৩ – দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট চাং হু-এইচওয়ান এক সফরে মিয়ানমারে পৌঁছার ঠিক আগমুহূর্তে উত্তর কোরিয়ার এক এজেন্টের আত্মঘাতী হামলায় দক্ষিণের চার মন্ত্রী ছাড়াও ১৬ জন নিহত হন।
১৯৮৫ – আন্তর্জাতিক পারমাণবিক অস্ত্রবিস্তার রোধ চুক্তিতে উত্তর কোরিয়ার স্বাক্ষর এবং পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন থেকে নিবৃত্ত থাকার প্রতিশ্রুতি।
১৯৮৭ – দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বিমানে উত্তর কোরীয় এজেন্টের রাখা বোমার বিস্ফোরণে ওই বিমানের ১১৫ জন আরোহী নিহত হন।
১৯৮৮ – ২৪তম অলিম্পিক গেমস সিউলে অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৯১ – উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার জাতিসংঘে যোগদান।
১৯৯৩ – আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্রবিস্তার রোধ চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত করে। সেই সাথে পরিদর্শক পাঠিয়ে তা তদন্ত করার সুপারিশ করে।
১৯৯৪ – উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম ইল-সাং-এর মৃত্যু, পুত্র কিম জং-ইল-এর নেতা হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ।
১৯৯৬ – উত্তর কোরিয়ার একটি সাবমেরিন দক্ষিণ কোরীয় উপকূলে অনুপ্রবেশ করে। এ সময় উপকূলরক্ষীদের হামলায় ২৪ জন অনুপ্রবেশকারী নিহত হন। এ ছাড়া এক কমান্ডোকে গ্রেপ্তার করা হয়। উত্তর কোরিয়ায় ব্যাপক বন্যার কারণে দুর্ভিক্ষে কয়েক মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়।
১৯৯৯ – পীত সাগরে সীমান্ত এলাকায় দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এতে ২০ জন সেনাসদস্যসহ উত্তর কোরিয়ার একটি জাহাজ ডুবে যায়।
২০০০ – উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-ইল এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম দায়ে-জং-এর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সীমান্ত লিয়াজোঁ অফিস এবং পরিবার পুনর্মিলনের ব্যবস্থা পুনরায় চালু করা হয়: এছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া 3,500 উত্তর কোরিয়ার বন্দীদের ক্ষমা দান করে।
২০০২ – মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ “গণবিধ্বংসী অস্ত্র ‘ গড়ে তোলা অব্যাহত রাখার দায়ে উত্তর কোরিয়া, ইরাক ও ইরানকে একটি “axis of evil” বলে অভিহীত করেন।
আবারও পীত সাগরে সংঘর্ষ। এতে ছয় সেনাসদস্যসহ দক্ষিণ কোরিয়ার একটি জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া উত্তর কোরিয়ার ১৩ জন নিহত হয়।
উত্তর কোরিয়া Yongbyon এ পরমাণুকেন্দ্র পুনরায় চালুর ঘোষণা দেয় ও জাতিসংঘের পরিদর্শকদের বহিষ্কার করে।
যৌথভাবে কোরিয়া ও জাপান ২০০২ ফিফা বিশ্বকাপের আয়োজন করে। দক্ষিণ কোরিয়া ফুটবল দল ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য সেমিফাইনালে উঠে।
২০০৩ – চীন, উ: ও দ: কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং রাশিয়া পারমাণবিক সমস্যার সমাধান করার জন্য ছয় পক্ষের আলোচনা শুরুর প্রাক্কালে উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্রবিস্তার রোধ চুক্তি থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেয়।
২০০৫ – উত্তর কোরিয়া প্রথম বারের মত ঘোষণা করেছে যে তাদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে এবং পারমাণবিক অস্ত্র মার্কিন “সাম্রাজ্যবাদ” থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য দরকার।
২০০৬ – উত্তর কোরিয়া ভূগর্ভস্থে তার প্রথম পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা সঞ্চালন করে। জাতিসংঘ উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ করে।
২০০৭ – জুলাই, একটি এইড প্যাকেজের অংশ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারী জ্বালানি তেলের 50,000 টন প্রাপ্তির পর উত্তর কোরিয়া Yongbyon পারমাণবিক চুল্লী বন্ধের ঘোষণা দেয়। অক্টোবর, পিয়ংইয়ং-এ কিম জং ইল-এর নেতৃত্বে উত্তর কোরিয়ার (DPRK) নেতৃবৃন্দ এবং রোহ মু-হুন-এর নেতৃত্বে দক্ষিণ কোরিয়ার নেতৃবৃন্দের মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জাপান সাগরে উত্তর কোরিয়া স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।
নভেম্বর, ১৫ বছর পর উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রীদের সাক্ষাৎ এবং আন্তঃসীমান্ত রেল সংযোগ ও একটি নতুন শিল্প কমপ্লেক্স নির্মাণসহ অর্থনৈতিক প্রকল্পের একটি ঘোষণা।
২০০৯ – মে, উত্তর কোরিয়া তার দ্বিতীয় ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক পরীক্ষা সম্পন্ন করে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এর নিন্দা করে।
আগস্ট, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের হস্তক্ষেপে উত্তর কোরিয়া আমেরিকান সাংবাদিক লরা লিং এবং ইউনা লিকে মুক্তি দেয়। সীমান্ত অবৈধভাবে পারাপারের জন্য এদেরকে ১২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
২০১০
২৬ মার্চ, দুই দেশের বিতর্কিত জলসীমায় দক্ষিণ কোরীয় চেওনান যুদ্ধজাহাজে বিস্ফোরণ। ৪৬ জন নাবিক নিহত।
২০ মে, বহুজাতিক তদন্তে দাবি, উত্তর কোরিয়ার ছোড়া টর্পেডোর আঘাতে চেওনানে ওই বিস্ফোরণ ঘটে।
২৪ মে, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সিউল। এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া তাদের জলসীমা দিয়ে উত্তর কোরিয়ার জাহাজ চলাচলেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
২৯ অক্টোবর, সিউলে জি-২০ সম্মেলনের আগে সীমান্ত এলাকায় দুই কোরিয়ার সেনাসদস্যরা গুলিবিনিময় করেন। নভেম্বর: উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়ার ওয়াইওনপিয়ং দ্বীপে গোলা ছোড়ে। দক্ষিণ কোরিয়াও এর জবাব দেয়। এতে দক্ষিণ কোরিয়ার দুজন নৌসেনা নিহত হন।
২০১১ – উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং-ইল-এর মৃত্যু, পুত্র কিম জং উন-এর দায়িত্ব গ্রহণ।
২০১২ – প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পার্ক চাং হি-র কন্যা পার্ক জিউন হাই দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়। উত্তর কোরিয়া সফলভাবে কক্ষপথে একটি “রকেট মাউন্টেড উপগ্রহ” প্রেরণ করে।
২০১৩ – উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন বিশ্বাসঘাতকার জন্য তাঁর চাচা জ্যাং সং-কে মৃত্যুদন্ড দেয়। পানামায় দুই মিগ-২১ জেট ফাইটারসহ উত্তর কোরিয়ার একটি চিনিবাহী জাহাজ আটক।
২০১৪ – একই দিনে নেদারল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের বৈঠক এবং জাতিসংঘের বিধি লঙ্ঘন করে উত্তর কোরিয়ার মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা।
২০১৫ – উত্তর কোরিয়া Yongbyon পারমাণবিক প্ল্যান্ট পুনরায় চালু করার ঘোষণা দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। উত্তর কোরিয়ায় শতাব্দীর সবচেয়ে দীর্ঘ খরার কারণে খাদ্যাভাব ও মানুষের মৃত্যু।
২০১৬ – উত্তর কোরিয়া সরকার ঘোষণা করে যে তারা একটি হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষা সফলভাবে করেছে!
সরকার প্রধান
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের তালিকা
উত্তর কোরিয়ার কিম বংশের শাসকগন
দুই কোরিয়ার এক হওয়ার স্বপ্ন
দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ সম্পর্ক অর্থাৎ দেশটিতে মার্কিন সেনার উপস্থিতি উত্তর কোরিয়ার জন্য সবসময়ই মাথাব্যথার বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। উত্তর কোরিয়ার ব্যাপক সামরিক শক্তি বিশেষ করে আত্মস্বীকৃত পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন বহিঃবিশ্বে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হিসাবে পরিগণিত।
’৯০’র দশকের শেষদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষ থেকে সানশাইন নীতি গ্রহণ করা হয়, যার মাধ্যমে দু’দেশের সম্পর্কের মধ্যে বরফ গলেছিল এবং দক্ষিণ কোরিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ উত্তর কোরিয়া সফর করেছিলেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ছিল দু’দেশের বিভক্ত পরিবারের মধ্যে পারিবারিক রি-ইউনিয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ১৯৯১ সালে দক্ষিণ ও উত্তর কোরিয়া একই সঙ্গে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করার পর তাদের মধ্যে সম্পর্কের কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন সূচির হয়, যা স্থায়ী রূপ লাভ করেনি। আলোচনা ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দুই কোরিয়া পরস্পরের আরো কাছাকাছি আসার চেষ্টা করেছে। সাম্প্রতিককালে দুই কোরিয়ার সম্পর্কের মধ্যে বৈরিতার মাত্রা বিভিন্ন কারণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। সবকিছুর পরেও, ২০১৫ সালে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে গিয়ে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশে বক্তব্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ে সংলাপের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। যা তাৎক্ষণিকভাবে দক্ষিণ কোরিয়াসহ সমগ্র বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার উপর কতিপয় সামরিক ক্ষেত্রে অবরোধ আরোপ করে।
শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য দুই কোরিয়া এ ধরনের কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তাদের সম্পর্কে মূলত বৈরিতার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়ে আসছে। একত্রীকরণের বাসনা সমগ্র কোরিয়া অঞ্চলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বরাবরই বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশে কোরিয়ার একত্রীকরণের বিষয়টি জটিল থেকে জটিলতর হলেও আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে দুই কোরিয়ার সম্পর্কের উন্নতি সবাই আশা করে। একদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যাপক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অন্যদিকের উত্তর কোরিয়ার চলমান দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, দুই কোরিয়ার জনগণের জন্য ক্রমাগত একটি অস্বস্তির বিষয় হিসাবে বিবেচিত। নিকট ভবিষ্যৎ বলে দেবে এক ইতিহাস, এক ভাষা, এক জাতি কোরিয়া উপদ্বীপ, ঔপনিবেশিক শাসন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল এবং স্নায়ুযুদ্ধের শিকার হয়ে ৩৮ অক্ষাংশে বিভক্ত দুটি রাষ্ট্র হিসাবে আর কতকাল অতিক্রম করবে। জনগণ যদি ক্ষমতার উৎস হয় এবং জনগণের ইচ্ছাই যদি জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হয় তাহলে আশা করা যায়, সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন বিভক্তিত কোরিয়ানরা পরাশক্তির রাজনীতির অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে দীর্ঘদিনের হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানি ভুলে আবার এক হবে।।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট, উইকিপিডিয়া, পত্র-পত্রিকা