হিন্দুধর্মকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন ধর্ম। জনসংখ্যার বিচারে হিন্দুধর্ম বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম, এই ধর্মের অনুগামীদের সংখ্যা ১০০ কোটিরও বেশি। ভারত এবং নেপালের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এছাড়া বাংলাদেশে, মরিশাসে ও ইন্দোনেশীয় দ্বীপ বালিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বাস করেন। জনসংখ্যার বিচারে হিন্দুধর্ম খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলামের পরেই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্মমত। ‘হিন্দু’ শব্দটি সিন্ধু নদ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ‘সিন্ধু’ দ্বিতীয় সহস্রাব্দে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা আর্যদের দ্বারা ব্যবহৃত একটি সংস্কৃত শব্দ। শব্দটির মাধ্যমে সিন্ধু নদ অববাহিকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হত। হিন্দুধর্ম একাধিক ধর্মীয় ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গঠিত। এই ধর্মের কোনো একক প্রতিষ্ঠাতা নেই। হিন্দুধর্মের প্রচুর শাস্ত্রগ্রন্থের মধ্যে বেদ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দুদের উল্লেখযোগ্য ধর্মানুশীলন পূজা, অর্চনা, ধ্যান, বার্ষিক অনুষ্ঠান এবং তীর্থযাত্রা। হিন্দুধর্মে ঈশ্বরধারণাটি অত্যন্ত জটিল। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন যে মানুষের আত্মা শাশ্বত। হিন্দুধর্মে দৈব ব্যক্তিত্বদের দেব বা দেবী নামে অভিহিত করা হয়।
হিন্দুধর্মের ব্যুৎপত্তি ও সংজ্ঞা
ভারতীয় উপমহাদেশের একাধিক স্থানীয় ধর্মমত একত্রে হিন্দুধর্ম নামে পরিচিত। অধিকাংশের ধারণায় হিন্দুধর্ম বহু দেবদেবী এবং বর্ণাঢ্য বা ভয়ঙ্কর সব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সমাহার। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি গভীর ধর্মদর্শন। পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন ধর্ম। হিন্দু মূলত সনাতন ধর্ম। ‘সনাতন’ শব্দের অর্থ শাশ্বত বা চিরন্তন; অর্থাৎ যা আগে ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে তাই সনাতন। হিন্দুধর্মের নির্দিষ্ট কোনো শুরু বা একক কোনো প্রবর্তক নেই। প্রায় পাঁচ হাজার বছে ধরে যুগযুগ ধরে ভারতের সমস্ত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সাঙ্গীকরণ ও স্বীকরণের মধ্যে দিয়ে ক্রমশ গড়ে উঠেছে এই ধর্ম। বিভিন্ন মুনি-ঋষি এবং মহামনীষীরা জীবন, জগৎ ও জগতের স্রষ্টা সম্পর্কে যেসব চিন্তা-ভাবনা করেছেন, সেসবেরই সমন্বিত রূপ হিন্দুধর্ম। তাঁদের চিন্তা-ভাবনা প্রথম বেদের আকারে প্রকাশ পায় এবং পরে এই বেদের ওপর ভিত্তি করেই হিন্দুধর্মের বিকাশ ঘটে; তাই এ ধর্মের অপর নাম হয় বৈদিক ধর্ম। হিন্দুধর্ম বহু সংস্কৃতির প্রভাবকে ধারণ করে অনেকটা মহীরুহের মত ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। হিন্দু সমাজ বহু জাতি ও বহু সংস্কৃতির মিশ্রণের ফল। হিন্দুরা বিশ্বাস করে যে, সনাতন ধর্মের অভ্যূদয় মানব সৃষ্টির শুরুতেই এবং তা স্থায়ী হবে সৃষ্টির বিলয় পর্যন্ত। এ ধর্ম স্বয়ম্ভূ ঈশ্বরে বিশ্বাস এবং এই বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় এই তিন সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সাধারণভাবে হিন্দুরা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। তাদের মতে প্রতিটি জীবই জন্ম, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের প্রক্রিয়াধীন। পুনর্জন্মের মাধ্যমে পাপ ক্ষয় দ্বারা মানুষ মোক্ষ লাভ করতে সক্ষম হয়। এ বিশ্বাসই হিন্দুধর্মের মূল ভিত্তি।
হিন্দুধর্ম আজ একাধিক শাখায় বিভক্ত। অতীতে এই ধর্ম ছয়টি দর্শনে বিভক্ত ছিল। বর্তমানে এগুলির মধ্যে কেবল বেদান্ত ও যোগেরই অস্তিত্ব আছে। আধুনিক হিন্দুধর্মের প্রধান বিভাগগুলি হল বৈষ্ণবধর্ম, শৈবধর্ম, স্মার্তবাদ ও শাক্তধর্ম। এছাড়াও একাধিক ছোটো বিভাগ বা উপবিভাগ লক্ষিত হয়, যাদের অনেকগুলিই পরস্পরের সঙ্গে অংশত আবৃত।
হিন্দুধর্মের ঐতিহাসিক বিবর্তন
হিন্দুধর্মের উদ্ভব ঘটেছে খ্রিস্ট জন্মের কমপক্ষে আড়াই হাজার বছর আগে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে, লৌহযুগ থেকে ঘটতে থাকা ভারতের ধর্মবিশ্বাসের নানা বিবর্তন এই ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই মতের উৎস আবার ব্রোঞ্জযুগীয় সিন্ধু সভ্যতা ও তৎপরবর্তী লৌহযুগীয় বৈদিক ধর্ম। বৈদিক যুগ বলতে আমরা বুঝি সেই যুগকে যখন বেদ রচনা করা হয়েছিল। ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে সময়ে আর্যদের মধ্যে বেদের প্রাধান্য ছিল, তাই বৈদিক যুগ নামে পরিচিত। বৈদিক ধর্ম ছিল প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষীদের একটি বলিকেন্দ্রিক ধর্ম। এরা ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ ইরানীয় মালভূমি থেকে হিন্দুকুশ হয়ে ভারতে প্রবেশ করতে শুরু করে এবং স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে মিশে যায়। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর পর ধীরে ধীরে ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতন ঘটলে বৈদিক ধর্মের নবজাগরণের রূপে ধ্রুপদি হিন্দুধর্মের উত্থান ঘটে। সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা ও বেদান্ত – হিন্দু দর্শনের এই ছয়টি প্রধান শাখার উদ্ভব ঘটে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে। প্রায় একই সময়ে ভক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে উদ্ভব ঘটে শৈবধর্ম ও বৈষ্ণবধর্মের মতো একেশ্বরবাদী মতবাদগুলির।
ধ্রুপদি পৌরাণিক হিন্দুধর্ম প্রতিষ্ঠালাভ করে মধ্যযুগে। আদি শংকরের অদ্বৈত বেদান্ত মতবাদও এই সময় প্রচারিত হয়। উক্ত মতবাদ বৈষ্ণব ও শৈব মতবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে এবং স্মার্তধর্মের উত্থান ঘটায়। এর ফলে দর্শনের অবৈদান্তিক শাখাগুলির অবলুপ্তি ঘটে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাখ্যা ও সংস্কারের মাধ্যমে বিবর্তিত হয়ে তা বর্তমান রূপ লাভ করেছে। হিন্দুধর্মের মূল উৎস বেদকে হিন্দুরা ঈশ্বরের বাণী বলে বিশ্বাস করে। পরে আরও অনেক ধর্মগ্রন্থ রচিত হলেও হিন্দুধর্মে বেদের প্রাধান্যই সর্বাধিক।
ভারতে মুসলমান শাসনকালে হিন্দুধর্ম ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। এই আন্দোলনের ফলস্রুতি অদ্যাবধি বিদ্যমান। আবার ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনকালে পাশ্চাত্য ভাবধারার অনুপ্রেরণায় হিন্দুধর্মে একাধিক সংস্কার আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই সকল ভাবধারার মধ্যে একটি উল্লেখ্যযোগ্য ভাবধারা ছিল স্পিরিটিজম (থিওজফি)। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ভারতীয় প্রজাতন্ত্র একটি হিন্দুপ্রধান ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র রূপে আত্মপ্রকাশ করে।
উপবিভাগ
হিন্দুধর্ম আজ একাধিক শাখায় বিভক্ত। অতীতে এই ধর্ম ছয়টি দর্শনে বিভক্ত ছিল। বর্তমানে এগুলির মধ্যে কেবল বেদান্ত ও যোগেরই অস্তিত্ব আছে। আধুনিক হিন্দুধর্মের প্রধান বিভাগগুলি হল বৈষ্ণবধর্ম, শৈবধর্ম, স্মার্তবাদ ও শাক্তধর্ম। এছাড়াও একাধিক ছোটো বিভাগ বা উপবিভাগ লক্ষিত হয়, যাদের অনেকগুলিই পরস্পরের সঙ্গে অংশত আবৃত। তবে আজকের হিন্দুরা মোটামুটিভাবে পূর্বোক্ত চারটি প্রধান শাখার কোনো না কোনো একটির সদস্য। ‘বেদান্ত বা উত্তর মীমাংসা’ হিন্দু দর্শনের একটি আস্তিক শাখা। বেদান্ত দর্শনের মূল ভিত্তি উপনিষদ্। “বেদান্ত” শব্দটির অর্থ “বেদের অন্ত বা শেষ ভাগ”। প্রথম দিকে বেদান্ত বলতে বোঝাত বেদ-এর শেষ অংশ উপনিষদ্-কেই। পরবর্তীকালে লেখা ভগবদ্গীতা ও ব্রহ্মসূত্র-ও বৈদান্তিক ধর্মগ্রন্থের স্বীকৃতি পায়। যদিও বলা হয়ে থাকে যে, কোনো একটি মাত্র বই বেদান্ত দর্শনের উৎস নয়। বেদান্ত দর্শনে বৈদিক যজ্ঞ ও ক্রিয়াকর্মের বদলে ধ্যান, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আধ্যাত্মিকতার প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
হিন্দুধর্মের প্রকৃতি ও মূলতত্ত্ব
হিন্দুধর্মের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো ফলের প্রত্যাশা না করে কাজ করা। ভগবদ্গীতায় এ বিষয়টি চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে। এ দর্শনের বক্তব্য অনুযায়ী সৃষ্টি রক্ষার্থেই মানুষকে সমাজের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হবে। কাজ না করলে সৃষ্টি লোপ পাবে। তবে মানুষকে এ কাজ করতে হবে কোনো প্রকার পুরস্কারের প্রত্যাশা না করে। যখন কোনো কাজ পুরস্কার বা প্রতিদানের প্রত্যাশায় করা হয় তখন তা বন্ধনের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। অপরদিকে ব্যক্তিক লাভালাভের প্রত্যাশা না করে কোনো কাজ করা হলে তা মোক্ষ লাভের কারণে পরিণত হয়। মানুষ তখন আর ব্যক্তিগত লোভ-লালসা বা পুরস্কারের প্রত্যাশায় আবদ্ধ থাকে না, তখন সে বিশ্বের সকলের সঙ্গে নিজেকে এক করে দেখতে শেখে।
সকল ক্ষেত্রেই শক্তি প্রয়োগ নীতিবহির্ভূত হিন্দুধর্ম এ দর্শনে বিশ্বাস করে না। উদাহরণ হিসেবে গীতায় বর্ণিত ক্ষত্রিয়ের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা বলা যায়। সেখানে রাষ্ট্রে একজন ক্ষত্রিয়ের করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ধর্মে অবশ্যই রাজনীতি ও শৌর্য-বীর্যের স্থান রয়েছে, তবে প্রেম-ভালোবাসার স্থান সকলের ওপরে। হিন্দুধর্মে সকল প্রাণী এমনকি পশুপাখিদের প্রতিও যথাযথ করুণা প্রদর্শনের নির্দেশ রয়েছে। হিন্দুধর্ম অনুযায়ী মানুষ, পশুপাখি সকল প্রাণীই সমভাবে পবিত্র। ফলে স্বাভাবিকভাবেই হিন্দুরা প্রাণিজগতের নির্বিচার নিধনে আতঙ্কিত হয়, যদিও মানুষের খাদ্য হিসেবে পশুপাখি প্রভৃতি হত্যা এ ধর্মেও স্বীকৃত। হিন্দুধর্মে মাংস ভক্ষণ স্বীকৃত হলেও নিরামিষ ভোজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তবে বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মাংসভক্ষণ একেবারেই নিষিদ্ধ।
প্রধান শাস্ত্রসমূহে এসবের পরিবর্তে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মানবপ্রেমের ওপরই অধিক জোর দেওয়া হয়েছে। মানুষের কাঙ্ক্ষিত নৈতিক দায়িত্ব পালনের জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুশীলন অত্যাবশ্যক। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ এগুলি মানুষকে কুপথে পরিচালিত করে নরকের দ্বারে নিয়ে যায়। একজন প্রকৃত হিন্দু এগুলিকে স্বীয় সৎ গুণাবলি দ্বারা দমন করেন। তিনি পবিত্রতা দ্বারা কামকে, প্রেম দ্বারা ক্রোধকে এবং ঔদার্য দ্বারা লোভ ও মোহকে সংবরণ করেন। বেদে বলা হয়েছে: ‘যে বাধা অতিক্রম করা কষ্টকর তা অতিক্রম কর। ক্রোধকে ভালবাসা দ্বারা এবং মিথ্যাকে সত্য দ্বারা জয় কর।’ মহাভারতে বলা হয়েছে: ‘স্বীয় জ্ঞানালোকে আলোকিত মহান ঋষিরা যেসকল ধর্মীয় নিয়ম বা সদাচার শিক্ষা দিয়েছেন, সেসবের মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণ শ্রেষ্ঠ।’ এই আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অর্জনের জন্য কৃচ্ছ্রতাসাধন ও বৈরাগ্য অবলম্বন প্রয়োজন। কিন্তু আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অর্জিত হয়ে গেলে আর এসবের প্রয়োজন থাকে না।
হিন্দুধর্মে অনুশোচনার পর্যাপ্ত বিধান রয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি পাপ করার পর তার জন্য অনুশোচনা করে বা পাপমুক্তির জন্য প্রবল আকুতি জানায়, তাহলে তার পাপ নষ্ট হয়ে যায়। যদি সে প্রতিজ্ঞা করে যে সে আর কখনই ওই পাপ করবে না, তাহলে সে পবিত্র হয়ে যাবে। হিন্দুধর্মমতে যিনি নিজেকে কর্ম থেকে বিরত রাখেন তিনি প্রকৃত সন্ন্যাসী নন। যোগাভ্যাস ও কর্ম উভয়ই সমার্থক। জ্ঞান ও কর্মের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। জ্ঞানীরা নন, বরং সাধারণ লোকেরাই জ্ঞান ও কর্মকে পৃথক মনে করে। একজন জ্ঞানী ও একজন কর্মীর অর্জিত শান্তি একই। তিনিই প্রকৃত সত্যের সন্ধান পান যাঁর দৃষ্টিতে জ্ঞান ও কর্ম এক।
বর্ণাশ্রম
ধর্ম এ সম্পর্কে মনুস্মৃতিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ঋগ্বেদের পুরুষসূক্তে এর বীজ নিহিত, যেখানে সমগ্র মানবসমাজকে এক বিশ্বমানব বা সমাজমানব হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই বিশ্বমানব বা বিরাটপুরুষের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য এবং পা থেকে শূদ্রের জন্ম হয়েছে। এভাবেই মাথা (মেধা), বাহু (শক্তি), উরু (ব্যবসা) এবং পা (কৃষি) সমন্বিত এক পুরুষের কল্পনা করা হয়েছে, যিনি অন্য সকল জীবের ওপর কর্তৃত্ব করেন। পুরুষসূক্ত এই বর্ণাশ্রমধর্ম অনুসারে মানুষকে চারটি সাধারণ ভাগে ভাগ করেছে। ভাগগুলি হলো: ক. ব্রাহ্মণ অর্থাৎ জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিক্ষা ও চিন্তাশক্তিতে পূর্ণ মানব; খ. ক্ষত্রিয় অর্থাৎ শৌর্য-বীর্যেপূর্ণ মানব; গ. বৈশ্য অর্থাৎ ব্যবসা ও অর্থ সংগ্রহে উৎসাহী মানব এবং ঘ. শূদ্র অর্থাৎ স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি যারা সীমিত চিন্তা-চেতনার বাইরে কোনো কাজ করতে পারে না এবং যারা শুধুমাত্র কায়িক পরিশ্রমের উপযুক্ত। এই সম্প্রদায়গুলো তৈরি করার অন্যতম কারণ হল কাজ ভাগ করে নেওয়া।
চতুর্বর্গ
হিন্দুধর্ম অনুযায়ী জীবনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য দুটি বিবর্তন ও উন্নয়ন এবং চূড়ান্ত মঙ্গল লাভ। চূড়ান্ত মঙ্গল বলতে এখানে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চতুর্বর্গকে বোঝানো হয়েছে। ধর্ম বলতে এখানে মানুষের ঐশ্বরিক গুণাবলির সমষ্টিকে বোঝায়, অর্থ হলো তার বৈষয়িক অবস্থা, কাম ইন্দ্রিয়সন্তুষ্টি আর মোক্ষ হচ্ছে সকল দুঃখ, সংশয় ও ভয় থেকে মুক্তি, অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুর আবর্ত থেকে মুক্ত হয়ে ব্রহ্মপ্রাপ্তি। এ সময় সে সর্বপ্রকার অহংবোধ ও বন্ধনদশা থেকে মুক্ত হয়। যখন কোনো ব্যক্তি মোক্ষ লাভ করে তখন সে জীবাত্মা ও পরমাত্মার স্বরূপ বুঝতে পারে।
চতুরাশ্রম
মনুস্মৃতিতে মানবজীবনের চারটি পর্যায়ের কথা বলা হয়েছে, যা আশ্রম বা চতুরাশ্রম নামে পরিচিত। সেগুলি: ক. ব্রহ্মচর্য বা আত্মসংযমের মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ কাল, খ. গার্হস্থ্য বা সংসার জীবনযাপনের মাধ্যমে সৃষ্টি রক্ষা, গ. বানপ্রস্থ (আভিধানিক অর্থ বনগমন) অর্থাৎ মোক্ষলাভের উদ্দেশ্যে সংসারের মায়া ত্যাগ করে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা এবং ঘ. সন্ন্যাস অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে সংসার ত্যাগ ও ষড়রিপু (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য) দমন করে মোক্ষ লাভের চেষ্টা। প্রত্যেক ব্যক্তিকে অবশ্যই জীবনের এ চারটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। এর মধ্য দিয়ে সে তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে এবং পরম ব্রহ্ম ও নিজের স্বরূপ বুঝতে পারে। ব্রহ্মচারী যখন সংসারজীবনে প্রবেশ করে তখন তাকে একাধিক লোকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়, যেমন তার পরিবারের সদস্যবর্গ, বন্ধু-বান্ধব, পাড়াপ্রতিবেশী ইত্যাদি এবং এভাবেই তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। বৈষয়িক পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে সে যখন বনে যায় তখন তার সম্পর্ক হয় প্রকৃতি তথা গাছপালা, লতাপাতা, নদনদী প্রভৃতির সঙ্গে। চূড়ান্ত পর্যায়ে একজন সন্ন্যাসী হিসেবে তিনি সব রকম সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেন; তখন তার অহংবোধ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়।
জন্মান্তরবাদ
হিন্দুধর্মের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো কর্মযোগে বিশ্বাস। এ বিশ্বাসমতে প্রতিটি ঘটনা বা ফলই বর্তমান জন্ম বা পূর্বজন্মের কর্মের ফল। আত্মা অবিনশ্বর। এক জনমে একে আবদ্ধ করা যায় না, বা এ পৃথিবীতে কয়েক বছর পরে তা ধ্বংসও হয় না। জীবের দৈহিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আত্মা এক দেহ থেকে অন্য দেহে স্থানান্তরিত হয় মাত্র। এভাবেই দেহ পরিবর্তনের মাধ্যমে পাপ ক্ষয় করে আত্মা মুক্তির দিকে এগিয়ে যায়। চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো পুনর্জন্ম থেকে নিষ্কৃতি, যার মাধ্যমে জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হয়। পুনর্জন্মে বিশ্বাস এবং পূর্ববর্তী জন্মের কর্মানুসারে পরবর্তী জীবনে আত্মার দেহ ধারণ একাধিক বিশ্বের (লোক বা ভুবন) অস্তিত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করে। পুনর্জন্মের বিষয়টি এ ধারণাকে সমর্থন করে যে, পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা যেমন এই বিশ্বের অস্তিত্ব অনুভব করি, তেমনি অন্য ইন্দ্রিয় ও চেতনদ্বারা অপর বিশ্বের অস্তিত্বও অনুভব করা যেতে পারে। এরই মাধ্যমে আত্মা মৃত্যু ও পুনর্জন্মের মধ্য দিয়ে এ পৃথিবীতে এক দেহ থেকে অন্য দেহে গমনাগমন করে; এমনকি মানুষ তার মনে সঞ্চিত আবেগ অনুযায়ী কখনও বেদনাবিধুর, কখনও বা আনন্দময় স্বপ্নও দেখে। হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে, কর্মের মাধ্যমে অর্জিত পাপ-পুণ্যের পরিমাণ ও গুণাগুণের ভিত্তিতে একজন মানুষ কোন ধরনের নরকে বা স্বর্গে ঠাঁই পাবে তা নির্ধারিত হয়। এ বিশ্বসমূহকে যেমন স্বর্গ ও নরক এ দুভাগে বিভক্ত করা হয়ে থাকে, ঠিক তেমনি উচ্চমার্গ ও নিম্নমার্গ এবং স্থূল ও সূক্ষ্ম পৃথিবী প্রভৃতি ভাগেও বিভাজন করা হয়ে থাকে।
সাকার ও নিরাকার উপাসনা
উপনিষদে বর্ণিত নিরাকার ব্রহ্ম সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেও সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উক্ত ধারণার পরিবর্তন ঘটে এবং বর্তমানে হিন্দুরা নিরাকার ব্রহ্মের বিভিন্ন ক্ষমতাকে সাকার কল্পনায় দেবতা হিসেবে পূজা করছে। এ সকল দেবতার প্রতি রয়েছে তাদের প্রগাঢ় ভক্তি-শ্রদ্ধা। নিরাকার ঈশ্বরের চেয়ে সাকার ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন বা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্পণ অনেক সহজ। নিরাকার ঈশ্বর সম্পর্কে উপনিষদীয় মতবাদের সঙ্গে বিভিন্ন দেবতার প্রতি ভক্তিযুক্ত পূজার্চনার মিশ্রণ একটি নতুন ধর্মীয় চেতনার জন্ম দেয়, যা ধর্মীয় চিন্তা-চেতনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে।
বৈষ্ণবধর্ম
রাধাকৃষ্ণের তত্ত্বভিত্তিক বৈষ্ণব মতবাদ এক নতুন পথের সন্ধান দেয়, যার ফলে বৈষ্ণবধর্ম প্রায় সমগ্র ভারতে সকল হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিস্তার লাভ করে। পরবর্তী সময়ে বৈষ্ণবধর্মের আধ্যাত্মিকতার অবনতি ঘটে। এই অবনতির যুগে বৈষ্ণবগণ ঈশ্বরপ্রেমের পরিবর্তে লৌকিক প্রেমে জড়িয়ে পড়েন, যা মূলত ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী। সৌভাগ্যক্রমে এ সময় বাংলায় আবির্ভাব ঘটে চৈতন্যদেবের। তিনি রাধাকৃষ্ণের প্রতি মানুষের অনুরাগকে উচ্চ অধ্যাত্মমার্গে উন্নীত করে ধর্মের এক অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে প্রচার করেন। ফলে বাংলা নৈতিক অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা পায়। তিনি ধর্মের নিছক আচার-আনুষ্ঠানিকতাকে বর্জন করে ধর্মের নৈতিকতাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেন। তাঁর ধর্মানুরাগ, ভক্তি ও ধর্মীয় উৎসাহ-উদ্দীপনা বৈষ্ণবধর্মে একটি বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্য সংযোজন করে, যা অবক্ষয়িত রূপের বিপরীতে এক নৈতিক ও ঐশ্বরিক আনন্দময়তায় সমুজ্জ্বল।
শৈবধর্ম
এই ধর্মের অনুগামীদের “শৈব” নামে অভিহিত করা হয়। শৈবধর্মে ভগবান শিবকে একমাত্র সর্বোচ্চ ঈশ্বর বলে মনে করা হয়; এই ধর্মের অনুগামীরা ভগবান শিবকেই স্রষ্টা, পালনকর্তা, ধ্বংসকর্তা, সকল বস্তুর প্রকাশ ও ব্রহ্মস্বরূপ হিসেবে পুজার্চ্চনা করেন। ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় শৈবধর্ম সুপ্রচলিত। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়াতেও শৈবধর্মের প্রসার লক্ষিত হয়।
শৈবধর্মের প্রাচীন ইতিহাস নিরুপণের কাজটি দুঃসাধ্য। হিন্দুধর্মের মহান গ্রন্থ মহাভারতের বর্ণণা অনুযায়ী কুরু বংশের কুল দেবতা ছিলেন ভগবান শিব। আর একারনেই কুরু বংশের একশত কৌরব ও পঞ্চ পান্ডব এবং তাদের পিতৃপুরুষ সকলেই শৈবধর্মের উপাসক ছিলেন। প্রাচীন যুগে বাংলার গৌড়েশ্বর মহারাজ শশাংক ছিলেন শৈবধর্মের উপাসক। তিনি তার নামের প্রথমে পরম শৈব উপাধি ব্যবহার করতেন। আর্যাবর্তে পাশুপত সম্প্রদায় সবচেয়ে প্রাচীন শৈব ধর্মাবলম্বী। এছাড়া প্রাচীন বাংলার সেন বংশীয় রাজারা ছিলেন শৈবধর্মের উপাসক। সেন রাজারা তাদের রাজকার্যের শুরুতে ভগবান শিবের স্তবের প্রচলন করেছিলেন। কিন্তু সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষন সেন পিতামহ ও পিতৃদেবের শৈবধর্মের প্রতি অনুরাগ ত্যাগ করে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহন করেন। এর ফলে রাজা লক্ষনকে অনেক দূর্গতি পোহাতে হয়েছিল। শৈবধর্মের সুন্দর নিয়ম নীতি ত্যাগ করে তিনি বৈষ্ণবীয় নিয়ম নীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে রাজকার্যে অমনোযোগী হয়ে পড়েন। তারপর একজন মুসলিম তুর্কি সেনাপতি মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী সৈন্যদলের দ্বারা আক্রমনের শিকার হয়ে রাজপ্রাসাদের পিছনের দরজা দিয়ে পলায়ন করে সপরিবারে প্রথম রাজধানী নবদ্বীপ / নদীয়া নৌকাযোগে থেকে দ্বিতীয় রাজধানী পূর্ববঙ্গের মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরে চলে আসেন। ধারণা করা হয় পিতামহ ও পিতৃদেবের শৈবধর্ম ত্যাগ করার কারনেই লক্ষন সেনের এরকম দূর্গতির কারন ছিল।
শাক্তধর্ম
হিন্দু দিব্য মাতৃকা শক্তি বা দেবী পরম ও সর্বোচ্চ ঈশ্বর – এই মতবাদের উপর ভিত্তি করেই শাক্তধর্মের উদ্ভব। এই ধর্মমতাবলম্বীদের শাক্ত নামে অভিহিত করা হয়। শাক্তধর্মমতে, দেবী হলেন পরব্রহ্ম। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। অন্য সকল দেব ও দেবী তাঁর রূপভেদমাত্র। দর্শন ও ধর্মানুশীলনের ক্ষেত্রে শাক্তধর্মের সঙ্গে শৈবধর্মের সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। যদিও শাক্তরা কেবলমাত্র ব্রহ্মের শক্তিস্বরূপিণী নারীমূর্তিরই পূজা করে থাকেন। এই ধর্মে ব্রহ্মের পুরুষ রূপটি হল শিব। তবে তাঁর স্থান শক্তির পরে এবং তাঁর পূজা সাধারণত সহায়ক অনুষ্ঠান রূপে পালিত হয়ে থাকে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই ভারতে শক্তিপূজা প্রচলিত। ২২,০০০ বছরেরও আগে ভারতের প্যালিওলিথিক জনবসতিতে প্রথম দেবীপূজার প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে সিন্ধু সভ্যতার যুগে এই সংস্কৃতি আরও উন্নত রূপে দেখা দেয়। বৈদিক যুগে শক্তিবাদ পূর্বমর্যাদা হারালেও পুনরায় ধ্রুপদী সংস্কৃত যুগে তার পুনরুজ্জীবন ও বিস্তার ঘটে। তাই মনে করা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই “হিন্দু ঐতিহ্যের ইতিহাস নারী পুনর্জাগরণের ইতিহাস রূপে লক্ষিত হয়।”
শাক্তধর্মের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সংস্কৃত সাহিত্য ও হিন্দু দর্শনের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল শক্তিবাদ। এমনকি আজও জনপ্রিয় হিন্দুধর্মের উপর এই মতবাদের প্রভাব অপরিসীম। ভারতীয় উপমহাদেশ ও তার বাইরেও বহু অঞ্চলে তান্ত্রিক ও অতান্ত্রিক পদ্ধতি সহ একাধিক পন্থায় শাক্ত ধর্মানুশীলন চলে। যদিও এই ধর্মের বৃহত্তম ও সর্বাধিক প্রচলিত উপসম্প্রদায় হল দক্ষিণ ভারতের শ্রীকুল (ত্রিপুরসুন্দরী বা শ্রী আরাধক সম্প্রদায়) এবং উত্তর ও পূর্ব ভারতের, বিশেষত বঙ্গদেশের কালীকুল (কালী আরাধক সম্প্রদায়)।
ধর্মীয় সংস্কার
সংস্কার আন্দোলন আঠারো শতকে ভারতীয় চিন্তাধারায় পাশ্চাত্য প্রভাব পড়ে, যা উনিশ শতকে ধর্মীয় সংস্কারকে ত্বরান্বিত করে। রাজা রামমোহন রায় ছিলেন এই সংস্কার আন্দোলনের প্রধান পুরুষ। তখন সংস্কারের ফলে একদিকে যেমন ব্রাহ্ম সমাজ (প্রার্থনা সমাজসহ), আর্য সমাজ ও আধ্যাত্মিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়, অন্যদিকে তেমনি রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে আমূল পরিবর্তন ঘটে। তখনকার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংস্কার হলো সতীদাহ প্রথা বিলোপ, বিধবাবিবাহ প্রচলন, বাল্যবিবাহ রোধ ইত্যাদি। ইসলাম ধর্মেও এ সংস্কারের প্রভাব পড়ে, যা উনিশ শতকের প্রথমদিকে ওহাবী আন্দোলনের জন্ম দেয়। ওহাবী আন্দোলন প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের লক্ষ্যে পরিচালিত হলেও সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তা ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবেও পরিচিতি লাভ করে। এ আন্দোলনের ব্যর্থতার পর স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে আলীগড় আন্দোলনের সৃষ্টি হয়, যা এখনও মুসলিম সমাজের একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে পরিচিত।
রামকৃষ্ণ মিশন
আঠারো শতকের শেষদিকে ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আবির্ভাব ঘটে। তিনি কেবল যুক্তিবাদের সঙ্গে পূর্ববর্তী সময়কার আবেগ ও আচারনির্ভর গোঁড়া ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতারই সমন্বয় সাধন করেননি, বরং আধ্যাত্মিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আপাত বিরোধী ধর্মসমূহের মধ্যেও সমন্বয় সাধন করেন। তাঁর অন্যতম প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ গুরু প্রচারিত সর্বজনীন মতবাদকে একটি নির্দিষ্টরূপ দেন। এর মাধ্যমে তিনি বেদান্ত দর্শনকে সর্বসাধারণের জন্য সহজলভ্য ও উন্মুক্ত করে তোলেন। বিবেকানন্দ তাঁর ধর্মগুরুর শিক্ষাকে একটি নির্দিষ্ট ধারায় পরিণত করেন এবং তা প্রচারের জন্য বিশ্বব্যাপী রামকৃষ্ণ মিশন গড়ে তোলেন। এ মিশন সংস্কারের মাধ্যমে হিন্দুধর্মকে সর্বজনগ্রাহ্য করার চেষ্টা চালাচ্ছে, যদিও এর কর্মকান্ড হিন্দুধর্মের বাইরেও বিস্তৃত। রামকৃষ্ণের মতানুসারে প্রতিটি ধর্মেই মোক্ষলাভের নিজস্ব উপায় আছে এবং হিন্দুধর্মের সঙ্গে অন্য কোনো ধর্মের অন্তর্নিহিত কোনো বিরোধ নেই। এ কারণে রামকৃষ্ণের মতবাদ বিভিন্ন ধর্মের মধ্যকার বাহ্যিক বিরোধ সমাধানে বিশেষ সহায়ক। হিন্দুধর্ম ভারতবর্ষের বিভিন্নমুখী কৃষ্টি ও সভ্যতার একটি অপূর্ব সংশ্লেষ। আস্তিক্যবাদে বিশ্বাস এবং উপনিষদ ও শঙ্করাচার্যের দর্শন সম্মিলিতভাবে একজন হিন্দুকে বিমূর্ত জ্ঞানলাভে সহায়তা করে।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ
হিন্দুধর্মের শাস্ত্রগ্রন্থের সংখ্যা প্রচুর। হিন্দুশাস্ত্র শ্রুতি ও স্মৃতি নামে দুই ভাগে বিভক্ত। এই গ্রন্থগুলিতে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন ও পুরাণ আলোচিত হয়েছে এবং ধর্মানুশীলন সংক্রান্ত নানা তথ্য বিবৃত হয়েছে। এই গ্রন্থগুলির মধ্যে বেদ সর্বপ্রাচীন, সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলি হল উপনিষদ্, পুরাণ, ও ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত। ভগবদ্গীতা নামে পরিচিত মহাভারতের কৃষ্ণ-কথিত একটি অংশ বিশেষ গুরুত্বসম্পন্ন ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পেয়ে থাকে।
হিন্দুধর্মের মূল উৎস বেদকে হিন্দুরা ঈশ্বরের বাণী বলে বিশ্বাস করে। পরে আরও অনেক ধর্মগ্রন্থ রচিত হলেও হিন্দুধর্মে বেদের প্রাধান্যই সর্বাধিক।
সমগ্র বেদ বা বৈদিক সাহিত্য চারটি প্রধান স্তরে সম্পূর্ণ। স্তরগুলি বৈদিক যুগের বিভিন্ন সময়ে গড়ে উঠেছে। প্রথম স্তরটি হলো সংহিতা। এটি বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশে নিবেদিত মন্ত্র বা শ্লোকের সমাহার। এসব মন্ত্র বা শ্লোকে দেবতাদের প্রশস্তি এবং তাঁদের নিকট কাঙ্ক্ষিত বিষয়ের প্রার্থনা স্থান পেয়েছে। মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক আরাধনা করলে দেবতারা সন্তুষ্ট হয়ে ভক্তদের বর প্রদান করেন। বেদের দ্বিতীয় স্তর ব্রাহ্মণসাহিত্য। এতে যজ্ঞসংক্রান্ত অনুষ্ঠানাদি বর্ণিত হয়েছে। হিন্দুধর্মে যজ্ঞকে সর্বাপেক্ষা পবিত্র কর্মসমূহের অন্যতম মনে করা হয়। এর অনুশীলনের ফলে স্বর্গের দ্বার উন্মুক্ত হয়। তৃতীয় স্তর হলো আরণ্যক। এ পর্বে ঈশ্বর আরাধনার মাধ্যমে অরণ্যে জীবন কাটানো এবং আধ্যাত্মিক জীবন গঠন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বেদের চতুর্থ পর্যায় হলো উপনিষদ, যাতে বিশ্বের রহস্য উন্মোচনে মানুষের আকুতি প্রকাশ পেয়েছে। এভাবে বৈদিক সাহিত্যে মানুষের বৈষয়িক পরিতৃপ্তি থেকে শুরু করে ঐশিক প্রেরণা অর্থাৎ ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের ব্যাকুল বাসনা স্থান পেয়েছে।
হিন্দুধর্মে বেদ ভিন্ন ধর্মীয় আচার-আচরণ সংক্রান্ত অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও টীকাগ্রন্থের ব্যবহার প্রচলিত আছে। সেগুলি স্মৃতিশাস্ত্র নামে অভিহিত। স্মৃতিশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত নয়, কারণ সময়ের পরিবর্তন ও জ্ঞানের বিকাশ সাপেক্ষে এর সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয়। তবে হিন্দুধর্মের বহুমাত্রিকতা সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা পাওয়ার জন্য বৈদিক সাহিত্যের পাশাপাশি স্মৃতিশাস্ত্রেরও চর্চা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ধর্মীয় মহাকাব্য রামায়ণ, মহাভারত, এমনকি পুরাণসমূহ চর্চারও প্রয়োজন আছে। গীতা হিন্দুধর্মের উপদেশমূলক একটি দার্শনিক গ্রন্থ। গীতা অনুযায়ী হিন্দুধর্ম একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তা বহুযুগ পার হয়ে মানব সমাজে আবির্ভূত একটি চিরন্তন ধর্ম। গীতায় ব্যবহূত ‘ধর্ম’ শব্দটি নির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়ের বিশ্বাসকে নির্দেশ করে না। এ শব্দটি দ্বারা এমন একটি বিশ্বাসকে নির্দেশ করা হয়েছে, যা ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষই অনুশীলন করতে পারে। তা হলো মানুষের গুণগত বা পেশাগত ধর্ম।
হিন্দুধর্মে দেব-দেবী
হিন্দুধর্মে দৈব ব্যক্তিত্বদের দেব (স্ত্রীলিঙ্গে দেবী) নামে অভিহিত করা হয়। বাংলায় দেবতা শব্দটি দেব শব্দের সমার্থক শব্দরূপে বহুল প্রচলিত। শব্দটির আক্ষরিক দৈব সত্ত্বা। আবার ইংরেজি ভাষায় শব্দটি গড শব্দের সমার্থক। হিন্দু সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলেন হিন্দু দেবগণ। চিত্রকলা ও স্থাপত্যে মূর্তির আকারে এবং বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে, বিশেষত ভারতীয় মহাকাব্য ও পুরাণে নানান উপাখ্যানে তাঁদের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঈশ্বরের থেকে এঁরা পৃথক। অনেক হিন্দুই তাঁদের ইষ্টদেবতার রূপে ঈশ্বরকে পূজা করে থাকেন। ইষ্টদেবতার নির্বাচন ব্যক্তিগত, আঞ্চলিক বা পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে হয়ে থাকে।
বেদে বিভিন্ন দেবদেবী, যথা অগ্নি, ইন্দ্র, বরুণ, ঊষা প্রমুখের বর্ণনা আছে। একটি বিশ্বাসমতে এসকল দেবদেবী প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির আধার; অপর মতে তাঁরা পরমেশ্বরেরই বিভিন্ন রূপের প্রকাশ। হিন্দুদের দেবতা অনেক। নিজ নিজ কর্ম অনুসারে তাদের ভাগ করা হয়েছে। যেমন হিন্দুদের প্রধান ৩ দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর বা মহাদেব (শিব)। তাদের সহধর্মিণীরা হলেন যথাক্রমে সরস্বতী ,লক্ষ্মী এবং পার্বতী(দুগা)। হিন্দুধর্মের ত্রিমূর্তি ধারণায় ব্রহ্মাকে বিশ্বচরাচরের সৃষ্টির প্রতীক, বিষ্ণুকে স্থিতির প্রতীক ও শিবকে ধ্বংসের প্রতীক রূপে কল্পনা করা হয়েছে। ব্রহ্মা সৃষ্টি করেন, বিষ্ণু পালন করেন আর শিব ধ্বংস করেন। এই সৃজন-পালন-সংহার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই জগৎসংসার চলমান আছে। ভাগবত পুরাণ মতে, ত্রিমূর্তির এই তিন দেবতার মধ্যে বিষ্ণুর পূজাই সর্বাপেক্ষা অধিক ফলপ্রদ।
প্রধান দেবতারা সকল শক্তির অধিকারী হলেও তাদের কিছু নিদিষ্ট কাজ সমাধান করতে নিয়োজিত থাকেন। যেমন প্রজাপতি ব্রহ্মার কাজ সৃষ্টি করা, অর্থাৎ তিনি এই ব্রহ্মাণ্ড এবং এর সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন। বিষ্ণু হলেন ব্রহ্মার সৃষ্ট সৃষ্টির পালন কতা। তিনি সকল কিছু পালন করেন,আর যিনি পালন করেন রক্ষার দায়িত্ব তো তাঁরই। মহাদেব যাকে শিবও বলা হয়ে থাকে, তিনি হলেন ধ্বংস কর্তা। তার কাজ হল যা কিছু সৃষ্টির জন্য অনিষ্টকর তা তিনি ধ্বংস করেন।
অগ্নি
একজন হিন্দু দেবতা। তিনি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈদিক দেবতা। অগ্নি আগুনের দেবতা এবং যজ্ঞের গ্রহীতা। অগ্নিকে দেবতাদের বার্তাবহ মনে করা হয়। তাই হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, যজ্ঞকালে অগ্নির উদ্দেশ্যে আহুতি প্রদান করলে সেই আহুতি দেবতাদের কাছে পৌঁছে যায়। অগ্নি চিরতরুণ, কারণ আগুন প্রতিদিন নতুন করে জ্বালা হয় এবং তিনি অমর। বেদে অগ্নি পৃথিবীর দেবতা। তিনি বায়ুর দেবতা বায়ু ও আকাশের দেবতা ইন্দ্রের সঙ্গে ঋগ্বেদে অন্যতম প্রধান দেবতা হিসেবে পরিগণিত হন। অগ্নি স্বর্গ ও মর্ত্যের যোগাযোগরক্ষাকারী দেবতা। বৈদিক যজ্ঞের সঙ্গে অগ্নির নাম সংযুক্ত। তিনি যজ্ঞের আহুতি লোকান্তরে নিয়ে যান। তাঁর বাহন মেষ।
বিষ্ণু
হিন্দু বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ দেবতা। আদি শংকর প্রমুখ স্মার্ত পণ্ডিতদের মতে, বিষ্ণু ঈশ্বরের পাঁচটি প্রধান রূপের অন্যতম। আবার তৈত্তিরীয় শাখা ও ভগবদ্গীতা আদি শ্রুতিশাস্ত্রে তাঁকে সর্বোচ্চ ঈশ্বরের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ‘বিষ্ণু সহস্রনামে’ গ্রন্থে বিষ্ণুকে পরমাত্মা ও পরমেশ্বর বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এই গ্রন্থে তাঁকে সর্ব জীব ও সর্ববস্তুতে পরিব্যাপ্ত সত্ত্বা; অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ তথা অনাদি অনন্ত সময়ের প্রভু; সকল অস্তিত্বের স্রষ্টা ও ধ্বংসকারী; বিশ্বচরাচরের ধারক, পোষক ও শাসক এবং বিশ্বের সকল বস্তুর উৎসপুরুষ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। পুরাণ অনুসারে, বিষ্ণুর গাত্রবর্ণ ঘন মেঘের ন্যায় নীল (ঘনশ্যাম); তিনি চতুর্ভূজ এবং শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম ধারী। ভগবদ্গীতা গ্রন্থে বিষ্ণুর বিশ্বরূপেরও বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই রূপের ধারণা বা কল্পনার শক্তি সাধারণ মানুষের নেই।
পুরাণে বিষ্ণুর দশাবতারেরও বর্ণনা রয়েছে। বিষ্ণুর এই দশ প্রধান অবতারের মধ্যে নয় জনের জন্ম অতীতে হয়েছে এবং এক জনের জন্ম ভবিষ্যতে কলিযুগের শেষলগ্নে হবে বলে হিন্দুরা বিশ্বাস করেন। বিষ্ণু সহস্রনামে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার উক্তিতে বিষ্ণুকে “সহস্রকোটি যুগ ধারিনে” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর অর্থ, বিষ্ণুর অবতারগণ সকল যুগেই জন্মগ্রহণ করে থাকেন। ভগবদ্গীতা অনুসারে, ধর্মের পালন এবং দুষ্টের দমন ও পাপীর ত্রাণের জন্য বিষ্ণু অবতার গ্রহণ করেন। হিন্দুদের প্রায় সকল শাখাসম্প্রদায়ে, বিষ্ণুকে বিষ্ণু বা রাম, কৃষ্ণ প্রমুখ অবতারের রূপে পূজা করা হয়।
দুর্গা
দুর্গা “যিনি দুর্গ বা সংকট থেকে রক্ষা করেন”; অন্যমতে, “যে দেবী দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছিলেন”। দুর্গা হলেন একজন হিন্দু দেবী। তিনি একজন জনপ্রিয় দেবী। হিন্দুরা তাঁকে মহাশক্তির একটি উগ্র রূপ মনে করেন। দেবী দুর্গার অনেকগুলি হাত। তাঁর অষ্টাদশভূজা, ষোড়শভূজা, দশভূজা, অষ্টভূজা ও চতুর্ভূজা মূর্তি দেখা যায়। তবে দশভূজা রূপটিই বেশি জনপ্রিয়। তাঁর বাহন সিংহ (কোনো কোনো মতে বাঘ)। মহিষাসুরমর্দিনী-মূর্তিতে তাঁকে মহিষাসুর নামে এক অসুরকে বধরত অবস্থায় দেখা যায়। হিন্দুধর্মে দেবী দুর্গা পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ। হিন্দু পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে তিনি শিবের স্ত্রী পার্বতী, কার্তিক ও গণেশের জননী, এবং কালীর অন্যরূপ।
দুর্গা মূলত শক্তি দেবী। বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে দুর্গার বিশেষ আলোচনা ও পূজাবিধি তন্ত্র ও পুরাণেই প্রচলিত। যেসকল পুরাণ ও উপপুরাণে দুর্গা সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে সেগুলি হল: মৎস্যপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ ও দেবী-ভাগবত। তিনি জয়দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বনদুর্গা, চণ্ডী, নারায়ণী প্রভৃতি নামে ও রূপে পূজিতা হন। বছরে দুইবার দুর্গোৎসবের প্রথা রয়েছে – আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শারদীয়া এবং চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে বাসন্তী দুর্গাপূজা।
গণেশ
গণেশ হিন্দু দেবতা। শিব ও পার্বতীর পুত্র গণেশ সিদ্ধিদাতা হিসেবে বিশেষভাবে পূজিত হন। তিনি খর্বাকৃতি, ত্রিনয়ন, চতুর্ভুজ এবং হস্তিমস্তক। শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী গণেশের বাহন হচ্ছে ইঁদুর। গণেশ মঙ্গল ও সিদ্ধির জনক বলে সব দেবতার আগে পূজিত হন। গণেশের গজানন এবং একদন্ত হওয়ার পেছনে পৌরাণিক কাহিনী বিদ্যমান। বিষ্ণুর বরে পার্বতী পুত্র লাভ করলে নবজাত শিশুকে দেখার জন্য দেবতারা উপস্থিত হন। এমন সময় শনিদেবের দৃষ্টিপাতে গণেশের মস্তক বিলুপ্ত হয়। তখন বিষ্ণুর কৃপায় হস্তিমুন্ড পেয়ে গণেশ বেঁচে ওঠেন। হস্তিমুন্ড গণেশ যাতে অবহেলিত না হয় সেজন্য দেবতারা নিয়ম করেন যে, সর্বাগ্রে গণেশের পূজা দিতে হবে। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ মতে, শিব-পার্বতীর দ্বাররক্ষক ছিলেন গণেশ। সেখানে পরশুরামের সঙ্গে গণেশের ভীষণ যুদ্ধ হয়। পরশুরামের কুঠারাঘাতে গণেশের একটি দাঁত সমূলে উৎপাটিত হয়; এজন্য গণেশ একদন্ত। গণেশ মহাভারতের লিপিকর বলে খ্যাত। তাঁর অপর নাম গজানন, লম্বোদর, বিনায়ক, সিদ্ধিদাতা ইত্যাদি। বাংলায় গণেশপূজা সাধারণত আলাদাভাবে হয় না; দুর্গাপূজার সময় অন্যান্য দেবতার সঙ্গে তাঁকেও পূজা দেওয়া হয়। দক্ষিণ ভারতে জাঁকজমক সহকারে গণেশের পূজা অনুষ্ঠিত হয়। ব্যবসায় সফলতা কামনায় হিন্দু ব্যবসায়ীরা গণেশকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা করে এবং বসতঘরে কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গণেশের মূর্তি বা ছবি রাখে।
শিব
শিব অনার্য দেবতা, অর্থাৎ আর্যদের ভারত আগমনের পূর্বে ভারতের আদিম জনগোষ্ঠীর দেবতা ছিলেন শিব। তিনি খুব প্রভাবশালী ছিলেন, তাই আর্যসমাজে তাঁর স্থান হয়েছে। বেদে তিনি রুদ্র নামে উল্লিখিত হয়েছেন। এই রুদ্রই পরবর্তীকালে শিব বা মহাদেব নামে বহুল পরিচিতি লাভ করে। শিবের সঙ্গে সমাজের একেবারে সাধারণ মানুষের নিবিড় সম্পর্ক দেখা যায়। তাঁর পার্ষদরা সমাজের নিম্ন শ্রেণীর প্রতিনিধি। তাঁর নিজের চলাফেরা, কাজকর্ম এমনকি পোশাক-পরিচ্ছদেও কৌলীন্যের ছাপ নেই। তাঁর পরিধানে ব্যাঘ্রচর্ম ও মৃগচর্মের উত্তরীয়, মাথায় জটা, গলদেশে সর্পের উপবীত এবং হাতে নানা রকম অস্ত্রশস্ত্র। বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীতে জানা যায় যে, দারিদ্রে্যর কারণে তাঁকে ভিক্ষাও করতে হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় তিনি প্রাচীন ভারতের একটি পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি অল্পতেই রুষ্ট, আবার অল্পতেই তুষ্ট হন। এজন্য তাঁকে ভোলানাথও বলা হয়। তাঁর মধ্যে একটি শিশুসুলভ কোমল মন লক্ষ করা যায়। কারও দুঃখকষ্ট এবং আবেদনে তিনি অতি সহজেই সাড়া দেন। তাই তাঁর বরে বৃত্র, বাণ প্রভৃতি অসুর অত্যাচারী হয়ে উঠলে শেষে ইন্দ্র, বিষ্ণু প্রভৃতির হাতে তারা নিহত হয়। কোনো কিছুর প্রতি তাঁর কোনো মোহ নেই। পুরাণাদির বর্ণনায় দেখা যায় শিব একা নন; তাঁর দাম্পত্য জীবনের সঙ্গিনী হচ্ছেন সতী (পরে পার্বতী, উমা বা দুর্গা); কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতী তাঁদের পুত্রকন্যা।
শিব জগতের কল্যাণের জন্য অনেক দুঃসাহসিক কাজ করেছেন। যেমন সমুদ্রমন্থনে উত্থিত তীব্র বিষ কণ্ঠে ধারণ করে তিনি পৃথিবীকে রক্ষা করেছেন। এতে তাঁর কণ্ঠ নীল হয়ে গেলে তাঁর নাম হয় নীলকণ্ঠ। ত্রিপুর নামক অসুরকে বধ করায় তাঁর নাম হয় ত্রিপুরারি। বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শিবের আরও অনেক নাম হয়। যেমন সকল দেবতার শ্রেষ্ঠ বলে তিনি মহাদেব। তাঁর প্রধান অস্ত্র ত্রিশূল, তাই তাঁর এক নাম শূলপাণি। পিনাক নামক ধনু ধারণ করেন বলে তাঁর অপর নাম হয় পিনাকী। শিবের ধ্বংসকারী অস্ত্রের নাম পাশুপত। প্রলয়কালে তিনি বিষাণ ও ডমরু বাজিয়ে সব কিছু ধ্বংস করেন, তাই তাঁর অপর নাম মহাকাল। তবে ধ্বংস থেকেই আবার নতুন সৃষ্টির শুরু বলে শিবকে মঙ্গলের দেবতাও বলা হয়। তিনি একাধারে মহাযোগী, সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী ও কঠোর তপস্যাকারী। তাঁর তপস্যাস্থল হিমালয়। কৈলাস তাঁর আবাস ভূমি। তাঁর অপর নাম আশুতোষ, যেহেতু তিনি অল্পতেই তুষ্ট হন। ভক্তিভরে শুধু একটি বিল্বপত্র দিলেই তিনি খুশি। শিবের গাজন এক সময় ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির অন্যতম প্রধান উৎসব ছিল। বর্তমানেও কোনো কোনো অঞ্চলে এ উৎসব পালিত হয়। হিন্দুদের ধর্ম, সংস্কৃতি এবং বিশ্বাস-ভক্তিতে আজও শিবের অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ়বদ্ধ।
কালী
কালী বা কালিকা হলেন একজন হিন্দু দেবী। তাঁর অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। প্রধানত শাক্ত ধর্মাবলম্বীরা কালীর পূজা করেন। তন্ত্রশাস্ত্রের মতে, তিনি দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত তন্ত্রমতে পূজিত প্রধান দশ জন দেবীর মধ্যে প্রথম দেবী। শাক্তরা কালীকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদিকারণ মনে করে। বাঙালি হিন্দু সমাজে দেবী কালীর মাতৃরূপের পূজা বিশেষ জনপ্রিয়।
পুরাণ ও তন্ত্র গ্রন্থগুলিতে কালীর বিভিন্ন রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে তাঁর মূর্তিতে চারটি হাতে খড়্গ, অসুরের ছিন্নমুণ্ড, বর ও অভয়মুদ্রা; গলায় মানুষের মুণ্ড দিয়ে গাঁথা মালা; বিরাট জিভ, কালো গায়ের রং, এলোকেশ দেখা যায় এবং তাঁকে তাঁর স্বামী শিবের বুকের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কালীর বিভিন্ন রূপভেদ আছে। যেমন – দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, চামুণ্ডা ইত্যাদি। আবার বিভিন্ন মন্দিরে “ব্রহ্মময়ী”, “ভবতারিণী”, “আনন্দময়ী”, “করুণাময়ী” ইত্যাদি নামে কালীপ্রতিমা প্রতিষ্ঠা ও পূজা করা হয়। আশ্বিন মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালীপূজা বিশেষ জাঁকজমক সহকারে পালিত হয়।
কার্তিক
কার্তিকেয় বা কার্তিক হিন্দু যুদ্ধদেবতা। তিনি শিব ও দুর্গার সন্তান। কার্তিক বৈদিক দেবতা নন; তিনি পৌরাণিক দেবতা। প্রাচীন ভারতে সর্বত্র কার্তিক পূজা প্রচলিত ছিল। উত্তর ভারতে ইনি এক প্রাচীন দেবতা রূপে পরিগণিত হন। অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীর মতো কার্তিকও একাধিক নামে অভিহিত হন। যথা – কৃত্তিকাসুত, আম্বিকেয়, নমুচি, স্কন্দ, শিখিধ্বজ, অগ্নিজ, বাহুলেয়, ক্রৌঞ্চারতি, শরজ, তারকারি, শক্তিপাণি, বিশাখ, ষড়ানন, গুহ, ষান্মাতুর, কুমার, সৌরসেন, দেবসেনাপতি ইত্যাদি।
কামদেব
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে, প্রেম বা কামকলার দেবতা। মানুষ ও দেবতার মনে প্রেম ও যৌনকামনার সৃষ্টি করেন বলে ইনি কামদেব। আবার কাম রূপকার্থে মঙ্গল। তাই মঙ্গলেরর দেবতা বিচারে- ইনি কামদেব নামে অভিহিত হয়ে থাকেন। সংস্কৃত কাম-দেব শব্দটির অর্থ ‘দিব্য প্রেম’ বা ‘প্রেমের দেবতা’। অর্থাৎ মানুষের মনে কাম দেন যে সত্তা। দেব শব্দের অর্থ দিব্য বা স্বর্গীয়; কাম শব্দের আক্ষরিক অর্থ ইচ্ছা, কামনা বা বাসনা, বিশেষত শারীরিক প্রেম বা যৌনতার ক্ষেত্রে।
তাঁর অন্যান্য নামগুলি হল রাগবৃন্ত (প্রেমের অঙ্কুর), অনঙ্গ (দেহহীন), কন্দর্প (দেবগণেরও কামনা সৃষ্টিকারী), মন্মথ (মন মন্থনকারী), মনসিজ (মন হইতে জাত, সংস্কৃতে বলা হয় সঃ মনসঃ জাত), মদন (নেশা সৃষ্টিকারী), রতিকান্ত (রতির পতি), পুষ্পবাণ, পুষ্পধন্বা (পুষ্পবাণধারী) এবং কাম (কামনা)। কামদেবের জন্মকাহিনি বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। কামদেব হিন্দু দেবী শ্রীর পুত্র। অন্যদিকে তিনি কৃষ্ণের পুত্র প্রদ্যুম্নের অবতার। তার স্ত্রী হলো আকাঙ্ক্ষার দেবী রতি। বৈষ্ণবরা তাঁর আধ্যাত্মিক সত্ত্বাটিকে কৃষ্ণের সমরূপ মনে করেন।
হনুমান
হনুমান হলেন হিন্দু ধর্মের একজন দেবতা যিনি রামের একনিষ্ঠ ভক্ত। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে, বায়ু (পবন) দেবতার ঔরসে অঞ্জনা (কেশরী নামক বানরের স্ত্রী) নামক বানরীর গর্ভে ইনি জন্মগ্রহণ করেন। হনুমান নামটি এসেছে হনু (“চোয়াল”) এবং মান (“বিশিষ্ট” বা “কদাকার”) শব্দদ্বয় থেকে। অর্থাৎ “হনুমান” শব্দার্থ “কদাকার চোয়ালবিশিষ্ট”। হিন্দু পুরাণে হনুমানকে বিশেষ স্থান দেয়া হয়েছে। রামায়ণ বর্ণিত হনুমান পবননন্দন হিসেবে হিন্দুদের নিকট পূজনীয়। রামায়ণের মূল চরিত্র রাম যাকে হিন্দুরা ভগবান বিষ্ণুর অবতার হিসেবে দাবি করে তার অনুগত চরিত্র হিসেবে পাওয়া যায় এই হনুমানকে। তিনি বায়ুদেবতার পুত্র। হিন্দুদের কাছে হনুমান রামভক্ত হিসেবে পরিচিত। রামায়ণের কাহিনী অনুসারে হনুমান সীতাকে উদ্ধারের জন্য লংকায় অভিযান চালান।
রাম
রাম হলেন হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিতে তাঁকে অযোধ্যার রাজা বলা হয়েছে। সপ্তম অবতার রাম ও অষ্টম অবতার কৃষ্ণ হলেন বিষ্ণুর অবতারগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দুধর্মে তিনি একজন জনপ্রিয় দেবতা। অযোধ্যার রাজা দশরথ ও তাঁর প্রধান স্ত্রী কৌশল্যার জ্যেষ্ঠপুত্র হলেন রাম। হিন্দুরা রামকে বলেন “মর্যাদা পুরুষোত্তম” (অর্থাৎ, “শ্রেষ্ঠ পুরুষ” বা “আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিপতি” বা “গুণাধীশ”)। তিনি সীতার স্বামী। সীতাকে হিন্দুরা লক্ষ্মীর অবতার মনে করেন। হিন্দুদের দৃষ্টিতে তিনি নারীর আদর্শ। রাম-সংক্রান্ত পৌরাণিক উপাখ্যানের প্রধান উৎস ঋষি বাল্মীকি রচিত রামায়ণ মহাকাব্য। রামায়ণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, রামের সীতা-অনুসন্ধান ও যুদ্ধজয়ের ক্ষেত্রে রামের প্রতি সীতার চরম প্রেম ও সতীত্বের প্রতি গুরুত্ব আরোপ। রাবণের বন্দিনী হওয়া সত্ত্বেও সীতার পবিত্রতা রক্ষিত হয়েছিল। অন্যদিকে, রামের ছোটো তিন ভাই লক্ষ্মণ, শত্রুঘ্ন ও ভরতও পবিত্রতা, ভ্রাতৃপ্রেম ও শক্তির আদর্শ। রামের গল্প ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বিশেষ জনপ্রিয়। হিন্দুধর্মে রাম অন্তহীন প্রেম, সাহস, শক্তি, ভক্তি, কর্তব্য ও মূল্যবোধের দেবতা।
কৃষ্ণ
কৃষ্ণ একজন হিন্দু আরাধ্য অবতার। এই ধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কৃষ্ণের পূজা করে থাকে। একাধিক বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে তাঁকে বিষ্ণুর অবতার রূপে গণ্য করা হয়; অন্যদিকে কৃষ্ণধর্মের অন্যান্য সম্প্রদায়গুলিতে তাঁকে স্বয়ং ভগবান বা সর্বোচ্চ ঈশ্বরের মর্যাদা দেওয়া হয়। সংস্কৃত কৃষ্ণ শব্দটির অর্থ কালো, ঘন বা ঘন-নীল। কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি বোঝাতে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কৃষ্ণের মূর্তিগুলিতে তাঁর গায়ের রং সাধারণত কালো এবং ছবিগুলিতে নীল দেখানো হয়ে থাকে। ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতে কৃষ্ণকে বিষ্ণুর অবতাররূপে বর্ণনা করা হয়েছে। কৃষ্ণ যাদব-রাজধানী মথুরার রাজপরিবারের সন্তান। তিনি বসুদেব ও দেবকীর অষ্টম পুত্র। কৃষ্ণের ছেলেবেলার গল্পগুলি থেকে জানা যায়, কিভাবে তিনি একজন রাখাল বালক হয়ে উঠলেন শৈশবেই কৃষ্ণ এতটাই দুর্ধর্ষ আর অপ্রতিরোধ্য প্রকৃতির ছিলেন যে তিনি তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টাগুলিকে চমকপ্রদভাবে বানচাল করে দিতে পারতেন এবং বৃন্দাবনবাসীর জীবনরক্ষা করতেন। কৃষ্ণের প্রাণনাশের জন্য কংশ পুতনা সহ অন্যান্য রাক্ষসদের প্রেরণ করলে সকলকে হত্যা করেন কৃষ্ণ।
কৃষ্ণ চরিত্রটি খুবই বৈচিত্র্যময়। বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁর যে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তাতে তাঁর তিনটি প্রধান রূপ লক্ষ্য করা যায়: পরোপকারী, প্রেমিক এবং রাজনীতিক। পরোপকারীর ভূমিকায় কৃষ্ণকে দেখা যায় তাঁর শিশু বয়স থেকেই। কৈশোরে কৃষ্ণ যে কাজগুলি করেন তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কংসবধ। অত্যাচারী কংস ছিল মথুরার রাজা। কৃষ্ণের প্রেমিক রূপের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর বৃন্দাবন লীলায়। গোপকন্যা এবং গোপস্ত্রী রাধার সঙ্গে তাঁর প্রণয়-সম্পর্ক পরবর্তীকালের বৈষ্ণব সাহিত্যের মূল প্রেরণা। কৃষ্ণকে কেউ কেউ অনার্য দেবতা বলেও আখ্যায়িত করেছেন। তাঁদের মতে আদিম জনগোষ্ঠীর উপাস্য এই দেবতা পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ্যধর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন এবং তাঁকে কেন্দ্র করেই বৈষ্ণবধর্মের প্রবর্তন হয়। কৃষ্ণ ঐতিহাসিক ব্যক্তি কিনা এ বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন তাঁর মানবীয় কোনো অস্তিত্ব ছিল না, আবার কারও কারও মতে তিনি একজন আদর্শচরিত্র ঐতিহাসিক পুরুষ, ধর্মপ্রবক্তা ও সংস্কারক ছিলেন এবং কালক্রমে ভক্তরা তাঁকে দেবতা, এমনকি ভগবানের পর্যায়ে উন্নীত করেন।
সরস্বতী
সরস্বতী হলেন জ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা, বুদ্ধি ও বিদ্যার হিন্দু দেবী। তিনি সরস্বতী-লক্ষ্মী-পার্বতীএই ত্রিদেবীর অন্যতম। এই ত্রিদেবীর কাজ হল ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবকে যথাক্রমে জগৎ সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংস করতে সাহায্য করা। সরস্বতীর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদে। বৈদিক যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত তিনি হিন্দুধর্মের একজন গুরুত্বপূর্ণ দেবী। হিন্দুরা বসন্তপঞ্চমী (মাঘ মাসের শুক্লাপঞ্চমী তিথি) তিথিতে সরস্বতী পূজা করে। তাঁর বর্ণ বরফের মতো সাদা, পরনে সাদা শাড়ি, গলায় সাদা পুঁতির মালা এবং হাতে থাকে কচ্ছপি নামের একটি বীণা। সরস্বতীর বর্ণনায় সাদা বর্ণের প্রাধান্য দেখা যায়, যা তাঁর শুদ্ধতার প্রতীক এবং স্বভাবে সাত্ত্বিক গুণের পরিচায়ক।
লক্ষ্মী
লক্ষ্মী হলেন একজন হিন্দু দেবী। তিনি ধনসম্পদ, আধ্যাত্মিক সম্পদ, সৌভাগ্য ও সৌন্দর্যের দেবী। তিনি বিষ্ণুর পত্নী। তাঁর অপর নাম মহালক্ষ্মী। জৈন স্মারকগুলিতেও লক্ষ্মীর ছবি দেখা যায়। লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা। লক্ষ্মী ছয়টি বিশেষ গুণের দেবী। তিনি বিষ্ণুর শক্তিরও উৎস। বিষ্ণু রাম ও কৃষ্ণ রূপে অবতার গ্রহণ করলে, লক্ষ্মী সীতা ও রাধা রূপে তাঁদের সঙ্গিনী হন। কৃষ্ণের দুই স্ত্রী রুক্মিনী ও সত্যভামাও লক্ষ্মীর অবতার রূপে কল্পিত হন। লক্ষ্মীর পূজা অধিকাংশ হিন্দুর গৃহেই অনুষ্ঠিত হয়। দীপাবলি ও কোজাগরী পূর্ণিমার দিন তাঁর বিশেষ পূজা হয়। বাঙালি হিন্দুরা প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপূজা করে থাকেন।
হিন্দুধর্মের পূজা-পার্বন
‘বারো মাসে তের পার্বন’ কথাটি হিন্দুদের বেলায় সঠিক। মকর সংক্রান্তি, সরস্বতী পূজা, থাইপুসাম, মহা শিবরাত্রি, দোলযাত্রা বা হোলি উৎসব, সিগমো, বসন্ত নবরাত্রি, রাম নবমী, গুড়িপারওয়া, উগাড়ি, ভিসু, হনুমান জয়ন্তী, শীতল শাস্থী, ভাত পূর্ণিমা, বনালু, বাথুকাম্মা, রথযাত্রা, রাজা পর্ব, গুরু পূর্ণিমা, মহালক্ষ্মী ভ্রাতা, অনাম, রাখী বন্ধন, কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী, গনেশ চতূর্থী, নবরাত্রি, বিজয় দশমী, দীপাবলী, কার্তিন পূর্ণিমা, পঞ্চগনপতি, কুম্ভমেলা, দূর্গা পুজা, কালী পুজা ইত্যাদি হিন্দুধর্মের উল্লেখযোগ্য উৎসব।
দেওয়ালি
হিন্দুদের উৎসব বিশেষ। এটি দীপাবলি, দীপান্বিতা, দীপালিকা, সুখরাত্রি, সুখসুপ্তিকা এবং যক্ষরাত্রি নামেও অভিহিত হয়। মহালয়ায় শ্রাদ্ধগ্রহণের জন্য যমলোক ছেড়ে যে পিতৃপুরুষগণ মর্ত্যে আগমন করেন বলে কল্পিত হয়, তাঁদের পথ প্রদর্শনার্থে উল্কা জ্বালানো হয়। এ কারণে ওইদিন আলোকসজ্জা ও বাজি পোড়ানো হয়। কেউ কেউ রাত্রিতে নিজগৃহে দরজা-জানালায় মোতবাতি জ্বালায়; কেউ বা লম্বা বাঁশের মাথায় কাগজের তৈরি ছোট ঘরে প্রদীপ জ্বালায়; একে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘আকাশপ্রদীপ’। http://www.bbc.co.uk/staticarchive/ccbacc78de49842a8c80ebfff11350c2a2f825ee.jpg
কৃষ্ণজন্মাষ্টমী
জন্মাষ্টমী বা কৃষ্ণজন্মাষ্টমী একটি হিন্দু উৎসব। এটি বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের জন্মদিন হিসেবে পালিত হয়। এর অপর নাম কৃষ্ণাষ্টমী, গোকুলাষ্টমী, অষ্টমী রোহিণী, শ্রীকৃষ্ণজয়ন্তী ইত্যাদি। হিন্দু পঞ্জিকা মতে, সৌর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে যখন রোহিণী নক্ষত্রের প্রাধান্য হয়, তখন জন্মাষ্টমী পালিত হয়। উৎসবটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্টার অনুসারে, প্রতি বছর মধ্য-আগস্ট থেকে মধ্য-সেপ্টেম্বরের মধ্যে কোনো এক সময়ে পড়ে। হিন্দুধর্মের অবতার শ্রী কৃষ্ণের শুভ জন্মাদিন উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নাম কীর্ত্তণ, প্রার্থনা এবং আলোচনা সভার পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথী শুভ জন্মাষ্টমী উদযাপন করে।
দশেরা-নবরাত্রি
দশহরা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকেও। দশ + অহ = দশারহ = দশহরা। ‘অহ’ শব্দের অর্থ দিন। ৯ রাত্রি ১০ দিন ধরে অবিরাম লড়াইয়ের পর দেবী দুর্গা দশম দিনে মহিষাসুরকে বধ করেন। সুতরাং এই দিন দেবীর জয়ের দিন। সে জয় ভারতবাসী উদযাপন করে মা দুর্গার পুজো করে। কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, পঞ্জাব, উত্তরাখণ্ড ও পশ্চিম বিহারে নবরাত্রির প্রথম দিনে মাটির টবে বার্লির বীজ পুঁতে দেওয়া হয়। বীজ থেকে যে অঙ্কুর বেরোয়, নয় রাত্রির পর দশম দিনে পুরুষরা তা তাঁদের টুপিতে পরেন বা কানের পিছনে লাগিয়ে রাখেন। এই অঙ্কুরকে সৌভাগ্যের প্রতীক ভাবা হয়। গোটা উত্তর ভারত ও মহারাষ্ট্রের একাংশে রামের সম্মানে দশেরা পালন করা হয়। রামের বিজয়ের দিনটি এঁরা পালন করেন রাবণ পুড়িয়ে। এ ব্যাপারে হিমাচলের কুলু দশেরা আলাদা করে উল্লেখের দাবি রাখে। কুলু শহরের ঢোলপুর ময়দানে যে মেলা বসে তাতে দেশ- বিদেশের পর্যটকরা ভিড় জামান। মহীশুরে দশেরা উদযাপন হয় মহিষাসুরমর্দিনীর বিজয়কে স্মরণ করে। এখানকার দশেরা মিছিলের খ্যাতি জগৎ জোড়া। দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য সর্বত্রই বিজয়াদশমী পালিত হয়। তবে প্রতিটি জায়গাতেই সেখানকার অনুষ্ঠানের স্থানীয় ব্যাখ্যা রয়েছে। নবরাত্রির ধুম সব চেয়ে বেশি গুজরাতে। এখানে দশ দিন ধরে উৎসব চলে। মা অম্বা ও মা আশাপুরার পূজা হয় খুব জাঁকজমক করে। এর সঙ্গে বসে গরবা নাচের আসর।
দুর্গাপূজা
দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হল হিন্দু দেবী দুর্গার পূজাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত একটি উৎসব। দুর্গাপূজা সমগ্র হিন্দুসমাজেই প্রচলিত। তবে বাঙালি হিন্দু সমাজে এটি প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। আশ্বিন বা চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গাপূজা করা হয়। আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজা শারদীয়া দুর্গাপূজা এবং চৈত্র মাসের দুর্গাপূজা বাসন্তী দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। শারদীয়া দুর্গাপূজার জনপ্রিয়তা বেশি। বাসন্তী দুর্গাপূজা মূলত কয়েকটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
দুর্গাপূজা ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল সহ ভারতীয় উপমহাদেশ ও বিশ্বের একাধিক রাষ্ট্রে পালিত হয়ে থাকে। তবে বাঙালি হিন্দু সমাজের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হওয়ার দরুন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যে দুর্গাপূজা বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে মালিত হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু হিন্দু সমাজেও দুর্গাপূজা বিশেষ উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয়। এমনকি ভারতের অসম,বিহার, ঝাড়খন্ড,মনিপুর এবংওড়িশা রাজ্যেও দুর্গাপূজা মহাসমারোহে পালিত হয়ে থাকে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যে প্রবাসী বাঙালি ও স্থানীয় জনসাধারণ নিজ নিজ প্রথামাফিক শারদীয়া দুর্গাপূজা ও নবরাত্রি উৎসব পালন করে। এমনকি পাশ্চাত্য দেশগুলিতে কর্মসূত্রে বসবাসরত বাঙালিরাও দুর্গাপূজা পালন করে থাকেন। ২০০৬ সালে গ্রেট ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রেট হলে “ভয়েসেস অফ বেঙ্গল” মরসুম নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীর অঙ্গ হিসেবে স্থানীয় বাঙালি অভিবাসীরা ও জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এক বিরাট দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন।
সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে “দুর্গাষষ্ঠী”, “মহাসপ্তমী”, “মহাষ্টমী”, “মহানবমী” ও “বিজয়াদশমী” নামে পরিচিত। আশ্চিন মাসের শুক্ল পক্ষটিকে বলা হয় “দেবীপক্ষ”। দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যাটির নাম মহালয়া; এই দিন হিন্দুরা তর্পণ করে তাঁদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করে। দেবীপক্ষের শেষ দিনটি হল কোজাগরী পূর্ণিমা। এই দিন হিন্দু দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। কোথাও কোথাও পনেরো দিন ধরে দুর্গাপূজা পালিত হয়। সেক্ষেত্রে মহালয়ার আগের নবমী তিথিতে পূজা শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুর শহরের মৃন্ময়ী মন্দির এবং অনেক পরিবারে এই রীতি প্রচলিত আছে। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাতে মহাসপ্তমী থেকে বিজয়াদশমী পর্যন্ত (শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মহাসপ্তমী থেকে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা পর্যন্ত) চার দিন সরকারি ছুটি থাকে। বাংলাদেশে বিজয়াদশমী সরকারি ছুটির দিন।
রাম নবমী
রামায়ণে অযোধ্যার রাজা দশরথ আর রাণী কৌশল্যার পুত্র রাম। পুরাণ অনুসারে ভগবান বিষ্ণুর দশাবতারের এক অবতার হলেন রাম। ত্রেতা যুগের শেষ ভাগে লংকার রাজা রাবণ খুব শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। স্বর্গ জয় করে তিনি দেবতাদের ওপর অত্যাচার শুরু করেন। পৃথিবীতেও অশান্তির সৃষ্টি হয়। রাক্ষস রাজের অত্যাচার হতে সৃষ্টিকে রক্ষার জন্য রাম অবতার হয়ে ভগবান বিষ্ণু ধরাধামে অবতীর্ণ হন। রামের জন্ম হয় নবমী তিথীতে। তাঁর জন্ম তিথীতে সারা পৃথিবীর সনাতন ধর্মাবলম্বীরা রাম নবমী উৎসব উদযাপন করে থাকেন।
প্রতি বছর চৈত্র মাসের শুক্লা পক্ষের নবমী তিথীতে রাম নবমী উৎসব উদযাপন করা হয়। উৎসবের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে উপবাস, পূজা, ভজন কীর্তন ইত্যাদি থাকে। আমাদের দেশে প্রতি বছর বিভিন্ন স্থানে উৎসবটি উদযাপন করা হয়ে থাকে। যশোরের অভয়নগরের রামসরায় অবস্থিত ইসকন মন্দিরে অত্যন্ত আড়ম্বরে রামনবমী উৎসব উদযাপন করা হয়। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার ভক্ত এখানে কয়েকদিন ধরে উদযাপিত উৎসবটি উপভোগ করে থাকেন। তখন মন্দিরের চারপাশের বিভিন্ন গ্রামে বাসিন্দাদের মধ্যে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। এ বছর ৩১ মার্চ থেকে কয়েকদিন ধরে উৎসবটি উদযাপিত হয়েছে।
বাসন্তী পূজা
বিশ্বের সকল শক্তির মিলিত রূপ দশভূজা মা দুর্গা বছরে দুবার পূজিত হন। শরৎকালে দুর্গাপূজাকে বলা হয় শারদীয় দুর্গাপূজা যা বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ উৎসব। বসন্তকালের দুর্গপূজাকে বলা হয় বাসন্তী পূজা। সারা পৃথিবীর সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ গত বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ২৮ মার্চ থেকে উদযাপন করছে এ বছরের বাসন্তী পূজা উৎসব। শারদীয় দুর্গাপূজার মতই পারিবারিক ও সার্বজনীন দুভাবেই আমাদের দেশে বাসন্তী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
মকর সংক্রান্তি
পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি বাঙালি সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ উৎসবের দিন। বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিন এই উৎসব পালন করা হয়। এই দিন বাঙালিরা বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠান আয়োজন করে খাকে। তার মধ্যে পিঠা খাওয়া, ঘুড়ি উড়ানো অন্যতম। সারাদিন ঘুড়ি উড়ানোব পরে সন্ধ্যায় পটকা ফুটিয়ে ফানুস উড়িয়ে উৎসবের সমাপ্তি করে। ভারতের বীরভূমের কেন্দুলী গ্রামে এই দিনটিকে ঘিরে ঐতিহ্যময় জয়দেব মেলা হয়। বাউল গান এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ। মূলত জ্যোতিষশাস্ত্রের একটি ক্ষণ। ‘মকরসংক্রান্তি’ শব্দটি দিয়ে নিজ কক্ষপথ থেকে সূর্যের মকর রাশিতে প্রবেশকে বোঝানো হয়ে থাকে। ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী ‘সংক্রান্তি’ একটি সংস্কৃত শব্দ, এর দ্বারা সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করাকে বোঝানো হয়ে থাকে। ১২টি রাশি অনুযায়ী এরকম সর্বমোট ১২টি সংক্রান্তি রয়েছে।
সরস্বতী পূজা
সরস্বতী পূজা হিন্দু বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবী সরস্বতীর আরাধনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠেয় একটি অন্যতম প্রধান হিন্দু উৎসব। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা আয়োজিত হয়। তিথিটি শ্রীপঞ্চমী বা বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত। উত্তর ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, নেপাল ও বাংলাদেশে সরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যে বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। শ্রীপঞ্চমীর দিন অতি প্রত্যুষে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্রছাত্রীদের গৃহ ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়। ধর্মপ্রাণ হিন্দু পরিবারে এই দিন শিশুদের হাতেখড়ি, ব্রাহ্মণভোজন ও পিতৃতর্পণের প্রথাও প্রচলিত। পূজার দিন সন্ধ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপগুলিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজিত হয়। পূজার পরের দিনটি শীতলষষ্ঠী নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে কোনো কোনো হিন্দু পরিবারে সরস্বতী পূজার পরদিন অরন্ধন পালনের প্রথা রয়েছে।
মহা শিবরাত্রি
পৌরানিক কাহিনীতে দেবাদিদেব মহাদেব বন্দনায় বলা হয়েছে তিনি হচ্ছেন সৃষ্টির উৎস আবার বিনাশের প্রতীক, তাঁর ইচ্ছেতেই চলছে আদি অন্তের সব ধটনা। জীবের কল্যানে সদা সর্বদা বর্ষিত হচ্ছে সৃষ্টি কর্তার আশীর্বাদ, শিব অল্পতেই তুষ্ট হয়ে থাকেন শুদ্ধ চিত্তে ‘ওঁ নমঃ শিবায়ঃ’ মন্ত্রেই মোক্ষলাভ হয় ভক্ত কূলের। ভক্তের বিশ্বাসেই ভগবানের অস্তিত্ব – মহা শিবরাত্রির পূন্য দিবসে ভগবান আর ভক্তের চিরায়ত সেই বিশ্বাস যে স্বমহিমায় বিরাজমান সত্যম শিবম সুন্দরমের দৃশ্যেই প্রস্ফুটিত। যেখানেই শিব সেখানেই শিব ভক্তের প্রার্থনার জালি হাতে দীর্ঘ লাইন।
ধর্মীয় উপাখ্যান অনুযায়ী শিবরাত্রিতে স্বামী সন্তান পরিবারের সুখ শান্তির জন্য যে নারী উপবাস পলনে শিব আরাধনায় দুধ আর বিল্বপত্রের পুস্পাঞ্জলীতে তাঁকে তুষ্ট করবেন – দেবাদিদেব মহাদেবের আশীর্বাদে দূর হবে জীবনের অবাবস্যা। শিবরাত্রির পবিত্র দিনে সূচী শূদ্ধ বস্ত্র পরিধানে সাধ্বী নারী দুধ, পবিত্র জল আর বিল্বপত্রে দেবাদিদেবকে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা জানাচ্ছেন সিঁথির সিঁদূর যেন থাকে অক্ষয়, পরিবারে আসে সুখ শান্তি। অন্যদিকে ভবিষ্যতের জীবন সঙ্গি যাতে হয় শিবের মতো সুন্দর আর উদার হৃদয়ের সেই প্রার্থনা জানাতে ব্যগ্র অনেকেই। ‘ওঁ নমঃ শিবায়ঃ’ আর ‘সত্যম শিবম সুন্দরমের’ মন্ত্রের আবাহনে চারিদিকে মহা শিবরাত্রির পুত পবিত্র দিনে।
দোলযাত্রা বা হোলি উৎসব
দোলযাত্রা একটি হিন্দু বৈষ্ণব উৎসব। বহির্বঙ্গে পালিত হোলি উৎসবটির সঙ্গে দোলযাত্রা উৎসবটি সম্পর্কযুক্ত। এই উৎসবের অপর নাম বসন্তোৎসব। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীগণের সহিত রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। দোলযাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহ আবির ও গুলালে স্নাত করে দোলায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রায় বের করা হয়। এরপর ভক্তেরা আবির ও গুলাল নিয়ে পরস্পর রং খেলেন। দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোলপূর্ণিমা বলা হয়। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়।
দোলযাত্রা উৎসবের একটি ধর্মনিরপেক্ষ দিকও রয়েছে। এই দিন সকাল থেকেই নারীপুরুষ নির্বিশেষে আবির, গুলাল ও বিভিন্ন প্রকার রং নিয়ে খেলায় মত্ত হয়। শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালনের রীতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই চলে আসছে। দোলের পূর্বদিন খড়, কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি জ্বালিয়ে এক বিশেষ বহ্ন্যুৎসবের আয়োজন করা হয়। এই বহ্ন্যুৎসব হোলিকাদহন বা নেড়াপোড়া নামে পরিচিত। উত্তর ভারতে হোলি উৎসবটি বাংলার দোলযাত্রার পরদিন পালিত হয়।
দোলযাত্রা বা হোলি উৎসব সংক্রান্ত পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথাগুলি মূলত দুই প্রকার: প্রথমটি দোলযাত্রার পূর্বদিন পালিত বহ্ন্যুৎসব হোলিকাদহন বা মেড়াপোড়া সংক্রান্ত, এবং দ্বিতীয়টি রাধা ও কৃষ্ণের দোললীলা বা ফাগুখেলা কেন্দ্রিক কাহিনি।
থাইপুসাম
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুসারিদের কাছে ভগবান শিব শক্তির দেবতা।ভারতের দক্ষিণাঞ্চলসহ থাইল্যান্ড, মালয়েশিযা, সিঙ্গাপুরে শিব মুরগান নামে পরিচিত। থাইপুসাম উৎসবে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করতে ভক্তরা শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুরিয়ে ভক্তি প্রকাশ করে।
হিন্দুধর্মের তীর্থস্থানসমূহ
হিন্দু ধর্মে অসংখ্য তীর্থস্থান রয়েছে। বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে হিন্দু ধর্ম মূলত প্রকৃতি পূজায় বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ফলে প্রকৃতির সাথে সংশ্লিষ্ট এ ধর্মের তীর্থস্থানের সংখ্যাও অনেক হয়েছে।
বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত হিন্দুধর্মের তীর্থস্থান:
বঙ্গভূমি – গয়া, দেওগড়, কালিঘাট, কামাখ্যা, তেরবেশর।
বিহার ও উড়িষ্যা – পুরানাথ, পুরী-জগন্নাথ।
পাঞ্জাব – জোয়ালামুকী, কুরুক্ষেত্র, কাটাস।
আগ্রা – বাটেশ্বর, বেনারশ, বৃন্দ্বাচল, বৃন্দাবন, চিত্রকুট, দেবীপতন, গংগোত্রী।
বোম্বে – এলান্দী, জিজুরী, দেওয়ারকা, পালিতানা, জিজুরী, পান্তরপুর, বিচরাজী।
মাদ্রাজ – ভবানী, চিদাম্বরাম, গোকর্ণ, কঞ্জিবরাম, রামেশওয়ারাম, সারেংগাতাম, তেরপতি।
মধ্য প্রদেশ – নাথপুয়ারা, অমরকান্তিক, বারোয়ানী, পুসখার, রাখবদেব।
দেবতার ভিত্তিতে হিন্দুধর্মের তীর্থস্থান সমূহের তালিকা:
বিষ্ণু – পুরী জগন্নাথ, তেরপতী, নাথদুয়ারী, বাদা রিনাথ, গয়া, হরপুয়ারা, পান্তরপুর।
কৃষ্ণ – মথুরা, গোকুল , শ্রীবৃন্দাবন, মহাবান, দোড়কা,কুরুক্ষেত্র, জ্যোতিশ্বর।
শিব – চিদাম্বরাম, দেক্তাড়, গোকর্ণ, তারাকেশর, হরিদুয়ারা, কেদারনাথ, বকরিসোয়ার, সোমনাথ মহাকালা, বৈদ্যনাথ, নাগানাথ, বিম্বনাথ মালিকার্জন, রামসোয়ার, ওমকারা ত্রিম্বাক ইত্যাদি।
কালী ও দূর্গা – বৃন্দাচল, হিংলাজ, দেবীপতন, কালীঘাট, কামাখ্যা, জোয়ালমূখী, আমভভানী, কমরিন ইত্যাদি।
পবিত্র নদী – গংগোত্রী, যমোত্রী, গড়মুক্তাস্বর, নাসীক, বাতেশ্বর, বাঘাসোয়ার, ভবানী, দেওয়া, প্রয়াগ, গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, চান্দদ, অমর কান্তক ইত্যাদি।
হিন্দু ধর্মের তীর্থস্থানের ধারণা শুধু উপর্যুক্ত স্থানসমূহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। অসংখ্য দেবালয়, টিলা, পাহাড়, জলপ্রাপাত, নদী, বৃক্ষ ইত্যাদি তীর্থস্থানের মর্যাদা লাভ করেছে। প্রসঙ্গত, দেব-দেবী ও বিশেষ বিশেষ স্থানসমূহে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের পূজা-অর্চনা ও এজাতীয় কর্মকাণ্ড ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করেছে। এখানকার মুসলমানেরা মাজার ও কবরস্থান কেন্দ্রিক যেসব কর্মকাণ্ড করে থাকে তা পৃথিবীর অন্য কোন অঞ্চলের মুসলিমদের মধ্যে দেখা যায় না।
সূত্র: উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট