হজ আল্লাহ তাআলার একটি বিশেষ বিধান। হজ ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি। আর্থিক ও শারীরিকভাবে সমর্থ পুরুষ ও নারীর ওপর হজ ফরজ। হজ সম্পর্কে কোরআন শরিফে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর তরফ থেকে সেই সব মানুষের জন্য হজ ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যারা তা আদায়ের সামর্থ্য রাখে।’ (সুরা আল ইমরান; আয়াত: ৯৭)।
শরীয়তের ভাষায়- শরীয়ত নির্দেশিত বিশেষ পদ্ধতিতে ইহরামসহ, ক্বা’বা শরীরে চর্তুদিকে তাওয়াফ করা, ‘সাফা’ ও ‘মারওয়া’ পাহাড়দ্বয়ের মধ্যস্থলে সাঈ করা এবং মাথা মুন্ডানোকে ওমরাহ বলে৷ এটিকে ‘ওমরা’ও বলা হয়৷ এ সম্পর্কে কোরআন করিমে রয়েছে: ‘নিশ্চয় সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনাবলির অন্যতম; তাই যারা হজ করবে বা ওমরাহ করবে, তারা এতদুভয়ের প্রদক্ষিণ (সায়ী) করবে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৫৮)।
হজের আভিধানিক অর্থ হলো ইচ্ছা করা ও সফর বা ভ্রমণ করা। ইসলামি পরিভাষায় হজ হলো নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত স্থানে বিশেষ কিছু কর্ম সম্পাদন করা। হজের নির্দিষ্ট সময় হলো আশহুরে হুরুম বা হারাম মাসসমূহ তথা শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ; বিশেষত ৮ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত পাঁচ দিন। হজের নির্ধারিত স্থান হলো মক্কা শরিফে কাবা, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফা, মুজদালিফা ইত্যাদি এবং মদিনা শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা শরিফ জিয়ারত করা। হজের বিশেষ আমল বা কর্মকাল হলো ইহরাম, তাওয়াফ ও সাঈ, অকুফে আরাফাহ, অকুফে মুজদালিফা, অকুফে মিনা, দম ও কোরবানি, হলক ও কছর এবং জিয়ারতে মদিনা-রওজাতুল রাসুল ইত্যাদি।
ওমরাহর আভিধানিক অর্থ হলো ধর্মকর্ম, ইবাদত, সুখকর, সেবা, স্থিতিশীল, জীবন, মহাপ্রাচীন, স্থাপত্য-স্থাপনা, প্রাপ্তি, অভ্যর্থনা, জিয়ারত বা সফর ও ইচ্ছা। যিনি ওমরাহ করেন, তাঁকে ‘মুতামির’ বলা হয়। ওমরাহর নির্দিষ্ট কাজকর্ম হলো ইহরাম, তাওয়াফ ও সাঈ, হলক, কছর ইত্যাদি। ওমরাহর নির্ধারিত স্থান হলো কাবা শরিফ, সাফা-মারওয়া ইত্যাদি। আফাকি তথা দূরবর্তী ওমরাহ সম্পাদনকারীর জন্য মদিনা মুনাওয়ারায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা শরিফ জিয়ারত করা সুন্নত। ওমরাহ সম্পাদনের বিশেষ কোনো সময় সুনির্দিষ্ট নেই; তবে হজের নির্ধারিত বিশেষ সময়ে (৮ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত পাঁচ দিন) ওমরাহ পালন করা বিধেয় নয়; এই পাঁচ দিন ছাড়া বছরের যেকোনো দিন যেকোনো সময় ওমরাহ প্রতিপালন করা যায়। হজের সফরেও ওমরাহ করা যায়। একই সফরে একাধিক ওমরাহ করতে বাধা নেই।
হজের ফরজ ৩টি
১। ইহরাম বাধা ২। উ’কুফে আ’রাফা (আরাফাতের ময়দানে অবস্থান)
৩। তাওয়াফুয্ যিয়ারাত
ওমরাহর ফরজ দুইটি
১। ইহরাম পরিধান করা
২। তাওয়াফ
হজের ওয়াজিব ৬টি
(১) ‘সাফা ও মারওয়া’ পাহাড় দ্বয়ের মাঝে ৭ বার সায়ী করা।
(২) অকুফে মুযদালিফায় (৯ই জিলহজ্জ) অর্থাৎ সুবহে সাদিক থেকে সুর্যদয় পর্যন্ত একমুহুর্তের জন্য
হলেও অবস্থান করা।
(৩) মিনায় তিন শয়তান (জামারাত) সমূহকে পাথর নিপে করা।
(৪) ‘হজে তামাত্তু’ ও ‘কি্বরান’ কারীগণ ‘হজ’ সমাপনের জন্য দমে শোকর করা।
(৫) এহরাম খোলার পূর্বে মাথার চুল মুন্ডানো বা ছাটা।
(৬) মক্কার বাইরের লোকদের জন্য তাওয়াফে বিদা অর্থাৎ মক্কা থেকে বিদায়কালীন তাওয়াফ করা।
এছাড়া আর যে সমস্ত আমল রয়েছে সব সুন্নাত অথবা মুস্তাহাব।
ওমরাহর ওয়াজিব দুইটি
(১) সাফা ও মারওয়া মধ্যবর্তী (সবুজ বাতি) স্থানে সাতবার সায়ী করা
(২) মাথার চুল মুন্ডানো বা ছাটা।
হজ যেমন জীবনে একবার ফরজ; তেমনি ওমরাহ জীবনে অন্তত একবার সুন্নত। রমজানে ওমরাহ পালন করা হজের সমান সওয়াব; শাওয়াল মাসও ওমরাহ করার জন্য উত্তম সময়। তবে হজ ফরজ থাকা অবস্থায় তা আদায়ের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও হজ সম্পন্ন না করে বারবার ওমরাহ করা অযৌক্তিক। কারণ, শত ওমরাহ একটি হজের সমকক্ষ হবে না। অনুরূপভাবে ওমরাহ আদায় করলে হজ ফরজ হয়ে যায় এমনটিও সঠিক নয়।
হজ তিন প্রকার:
১) হজ ইফরাদ : শুধু হজের ইহরামের নিয়ত করে তা সম্পন্ন করলে একে ‘ইফরাদ হজ’ বা একক হজ বলা হয়।
২) হজ কেরান : হজ ও ওমরাহর জন্য একত্রে ইহরামের নিয়ত করে একই ইহরামে তা সম্পন্ন করলে তাকে ‘কিরান হজ’ বা যৌথ হজ বলা হয়।
৩) হজ তামাত্তু : একই সফরে প্রথমে ওমরাহর ইহরামের নিয়ত করে, তা সম্পন্ন করে পুনরায় হজের জন্য ইহরামের নিয়ত করে তা সম্পাদন করাকে ‘তামাত্তু হজ’ সুবিধাজনক হজ বলা হয়।
ইহরাম
ইহরাম হল হজ্জ বা উমরার জন্য নির্ধারিত একটি অবস্থা। মিকাত নামক নির্ধারিত স্থানগুলো অতিক্রম করার পূর্বেই ইহরাম অবস্থা ধারণ করতে হয়। ُ (ইহরাম) শব্দটি حَرَامٌ (হারাম) শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ হলো কোনো জিনিসকে নিজের ওপর হারাম বা নিষিদ্ধ করে নেয়া। আর এ ইহরামই হজ ও ওমরার প্রথম ফরজ কাজ। পুরুষদের জন্য সেলাইবিহীন দুই টুকরো সাদা কাপড় আর নারীদের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যময় শালীন পোশাক পরিধান করাই হলো ইহরাম। হজ ও ওমরা পালনকারী ব্যক্তি ইহরামের মাধ্যমে নিজের ওপর স্ত্রী সহবাস, মাথার চুল, হাতের নখ, গোঁফ, বগল ও নাভির নিচের ক্ষৌর কর্যাদি, সুগন্ধি ব্যবহার, সেলাই করা পোশাক পরিধান এবং শিকার করাসহ কিছু বিষয়কে হারাম করে নেয়। ইহরামের মাধ্যমে হজ ও ওমরা পালনকারী ব্যক্তির জন্য স্বাভাবিক অবস্থার অনেক হালাল কাজও হারাম হয়ে যায়। হজ ও ওমরার জন্য ইহরামে ফরজ করা হয়েছে। মক্কায় প্রবেশ করতে ইহরাম করতে হয়।
মিকাত
ইহরামের নির্ধারিত সীমানাকে মিকাত বলে। যেখানে ইচ্ছা সেখান থেকেই ইহরাম পরিধান করে হজ্বের জন্য যাত্রা শুরু করা যায়। তবে কিছু নির্দিষ্ট জায়গা অগ্রসর হতে আবশ্যিকভাবে ইহরাম পরিধান করেই অগ্রসর হতে হয়। এই স্থানগুলোকে শরীয়তের পরিভাষায় মিকাত বলা হয়। এরূপ নির্দিষ্ট মিকাতের সংখ্যা পাঁচটি, যার থেকে অগ্রসর হতে হলে অবশ্যই ইহরাম পরিধান করতে হবে। সড়কপথে হজ্ব যাত্রা করলে নির্ধারিত মিকাতে গিয়ে ইহরাম পরিধান করা সুবিধাজনক। কিন্তু বিমানপথে ভ্রমণ করলে নির্ধারিত মিকাত ইহরাম ছাড়াই অতিক্রম হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকায় বা বিমানের মধ্যে ইহরাম পরিধানের অসুবিধার কারনে নিজের ঘর থেকেই ইহরাম পরিধান করে যাত্রা করাই উত্তম। বাংলাদেশ থেকে আমাদের মিকাত হলো ইয়ালামলাম পাহাড়। মদিনা থেকে মিকাত হলো জুলহুলায়ফা নামক স্থান। মক্কা থেকে ওমরাহ করতে চাইলে তার মিকাত হলো তানয়িম, যেখানে আয়িশা (রা.) মসজিদ অবস্থিত অথবা জিরানা নামক জায়গা। ইহরাম ছাড়া মিকাত অতিক্রম করলে ওয়াজিব তরক হয় বিধায় কাফফারা হিসেবে একটি কোরবানি দিতে হয়। মক্কা থেকে হজের ইহরামের জন্য মিকাত প্রযোজ্য নয়।
ওমরাহ সম্পাদন-প্রক্রিয়া:
- ইহরাম বাঁধা
- কাবা শরীফ তাওয়াফ করা (৭ বার চক্বর পূর্ণ করা)
- মাকামে ইব্রাহীমের পিছনে ২ রাকাত সুন্নাত নামাজ আদায় করা
- যমযম কুপের পানি পান করা
- সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে ৭ বার সায়ী করা
- মাথা মুন্ডানো বা চুল ছাঁটা
মক্কায় যাওয়ার পর কাবা শরিফের চারদিকে সাতবার প্রদক্ষিণ করলে এক তাওয়াফ সম্পন্ন হয়। তাওয়াফের নিয়ত, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদু তওয়াফা বাইতিকাল হারাম ফা ইয়াছছিরহু লি ওয়া তাকাব্বাল হু মিন্নি ছাবআতা আশওয়াতিল লিল্লাহি তাআলা আজ্যা ওয়া জাল্লা।’ মহান আল্লাহ তাআলার উদ্দেশে সাত চক্কর দেওয়ার পর বলতে হয়, ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ্।’ তাওয়াফ শেষে মাকামে ইবরাহিমে অথবা মসজিদে হারামের যেকোনো জায়গায় দুই রাকাত ওয়াজিবুত তাওয়াফ নামাজ আদায় করতে হয়। এরপর জমজমের পানি পান করে সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সাতবার সাঈ করতে বা দৌড়াতে হবে।
হজ সম্পাদন প্রক্রিয়া
যেহেতু ৮ থেকে ১৩ জিলহজ মূল হজের সময়, তাই যাঁরা ইহরামে নেই তাঁরা ৭ জিলহজ হজের ইহরাম করবেন। এই ইহরামের তালবিয়া (লাব্বাইক) চলতে থাকবে ১০ জিলহজ শয়তানকে পাথর মারার আগ পর্যন্ত। ইহরাম করে মিনায় যেতে হবে, ৮ জিলহজ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মিনায় আদায় করা সুন্নত। ৯ জিলহজ সকালে আরাফাতে যেতে হবে। ৯ জিলহজ সূর্যাস্তের পর মুজদালিফায় পৌঁছে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করতে হবে। মুজদালিফায় রাতযাপন ও এখান থেকে ৭০টি কঙ্কর সংগ্রহ করতে হবে। ১০ জিলহজ সকালে মিনায় গিয়ে বড় শয়তানকে ৭টি পাথর মারতে হবে। পাথর মারার দোয়া, ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার! রাগমান লিশ-শায়তান ওয়া রিদাআন লির-রহমান। আল্লাহুম্মাজ-আলহু হাজ্জাম মাবরুরাওঁ ওয়া জাম্বাম মাগফুরাওঁ ওয়া ছাইয়াম মাশকুরাওঁ ওয়া তিজারাতান লান তাবুর।’ (প্রতি কঙ্কর নিক্ষেপের সময় বিসমিল্লাহ পড়ুন)।
তারপর পশু কোরবানি করতে হবে। এরপর নারীরা চুল কাটবেন, পুরুষেরা চুল ছাঁটবেন বা মাথা মুণ্ডন করবেন। এরপর ১০ থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক পোশাকে তাওয়াফে জিয়ারত করবেন। তারপর ১১ ও ১২ জিলহজ উভয় দিন তিন শয়তানকে ৭টি করে ২১টি পাথর মারতে হবে। এ সময় মিনায় অবস্থান করা সুন্নত। ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের আগেই মিনা ছাড়তে হবে, তা না হলে ১৩ জিলহজও মিনায় অবস্থান করতে হবে এবং সেদিনও তিন শয়তানকে ৭টি করে ২১টি পাথর ছুড়তে হবে। বিদেশি হাজিরা মক্কা শরিফ থেকে প্রস্থানের আগে বিদায়ী তাওয়াফ করবেন।
তথ্য ও ছবিসূত্র : পত্র-পত্রিকা ও ইসলামিক ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহিত