বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কিছু কবিতা আবৃত্তিসহ এখানে দেওয়া হল। কবিতা ও আবৃত্তির অডিওগুলো ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত। কবিতার কথা ও আবৃত্তির দুষ্প্রাপ্যতার কারণে অনেক জনপ্রিয় কবিতা বাদ পড়েছে। ভবিষ্যতে সম্ভব হলে আপডেট করা হবে।
০১। কেউ কথা রাখেনি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আবৃত্তি:
কেউ কথা রাখেনি
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী
আর এলোনা
পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি।
মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর
খেলা করে!
নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়
তিন প্রহরের বিল দেখাবে?
একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো
লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরা
ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি
ভিতরে রাস-উৎসব
অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা
কত রকম আমোদে হেসেছে
আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি!
বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন, আমরাও…
বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই
সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস-উৎসব
আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবেনা!
বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!
ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ নিয়েছি
দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম
তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে-কোনো নারী।
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না!
০২। আমিই সেই মেয়েটি – কবিতা সিংহ আবৃত্তি: ব্রততী বন্দোপাধ্যায়
আমিই সেই মেয়েটি
আমিই সেই মেয়েটি সেই মেয়ে যার জন্মের সময় কোন শাঁখ বাজেনি জন্ম থেকেই যে জ্যোতিষীর ছঁকে বন্দী যার লগ্ন রাশি রাহু কেতুর দিশা খোঁজা হয়েছে না, তার নিজের জন্য নয় তার পিতার জন্য আর ভাই এর জন্য তার স্বামীর জন্য তার পুত্রের জন্য কিন্তু যার গর্ভ থেকে আমার জন্ম সেই মায়ের কথা বলেনি কেউ। আমিই সেই মেয়েটি সেই মেয়েটি যে জন্ম থেকেই বিবাহের জন্য বলি প্রদত্ত যার বাইরের চেহারা চোখ – নাক-মুখ- ত্বক- চুল – রঙ নিয়েই দর কষাকষি কাল না ফর্সা খাঁদা না টিকালো লম্বা না বেঁটে খুতখুতে না টানা টানা যার মাথার বাইরেটা নিয়েই সকলের ভাবনা মাথার ভিতরটা নিয়ে কারও কোন মাথা ব্যথা নেই আমিই সেই মেয়েটি যে ছোটবেলা থেকে শুনেছে জোরে জোরে কথা বলতে নেই ছুটতে নেই -চেঁচাতে নেই- হাসতে নেই এমন কি কাঁদলেও তা লুকিয়ে লুকিয়ে আমিই সেই মেয়েটি যাকে বলতে নেই – খিদে পেয়েছে – ঘুম পেয়েছে – ইচ্ছে করছেনা- ক্লান্ত লাগছে -আর পারছিনা — আর পারছিনা। আমিই সেই মেয়েটি খেলার জন্য যার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে পুতুল পুতুলের আদল পাবার জন্য পুতুলের সংসার বানাবার জন্য। আমিই সেই মেয়েটি যে গত কোন শতাব্দী তে পাঁচ বছর বয়সে মালা দিয়েছে – গঙ্গা যাত্রীর গলায় কুলীন ব্রাম্মন এর তিনশো পঁয়ষট্টি তম স্ত্রীর অন্যতমা হয়ে স্বামীর গরবে হয়েছি গরবিনী একাদশীর দিন অবুজ দশমীর বালিকার তৃষ্ণায় – আটক ঘরের মাটি লেহন করতে করতে প্রান ত্যাগ করেছি সন্তানের পর সন্তান জন্ম দিতে দিতে যন্ত্রণায় মুখ থুবড়ে পরেছি সূতিকাগারে জ্বলে পুড়ে মরেছি সতীদাহে। আমি বুঝতে পারিনি যে চাকরীর জায়গায় নিজের কাজের কুশলতা দেখাতে নেই আমি বুঝতে পারিনি যে আমার প্রেমিককে তার প্রেম পত্রের বানান ভুল গুল ধরিয়ে দেওটাই আমার ভুল হয়ে ছিল আমি বুঝতে পারিনি আমি যদি কবি হতে চাই আমার বন্ধুরা বলবে ''ওটা কবিতা হয়নি পদ্য হয়েছে'' আমি বুঝতে পারিনি যে বিংশ শতাব্দীর শেষ সীমানায় এসে দাড়িয়েও এইপুরুষ শাসিত সমাজ বুদ্ধিমতিদের জন্য অপ্রস্তুত আমি সেই মেয়েটি যে দেখেছে একটি নারী কেমন করে নিছক মেয়েছেলে বনে যায় চরিত্রের উলটো দিকে হেঁটে যায় সফল স্বামীদের গিন্নীরা শিক্ষার চেয়ে উজ্জলতা পায় বেনারসি সাড়ীর ফুলকি বুদ্ধির চেয়ে দিপ্তিমান হয়ে ওঠে অন্ধকারে হীরা পান্না আমি সেই মেয়েটি জানেন আমি সেই মেয়েটি যে জীবনের কয়েকটি বছর ভুলের পরে ভুল পুনরুপি ভুল করে চলেছি অন্ধকারের দিনে ফিরতে পারিনা বলেই কি আমি অপমানের জলন্ত কয়লার উপর দিকে হেঁটে যেতে চাই যেতে চাই দুঃখের দিকে আমি প্রনাম জানাই সেই প্রথম আগুনকে যার নাম বর্ণপরিচয় সেই অগ্নি সুদ্ধ পরম্পরাকে সেইসব পুরুষ রমণীকে যারা উনবিংশ শতাব্দীর অন্ধকারের হাতলে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে এক জন্মে আমাকে জন্ম জন্মান্তরের দরজা খুলে দিয়েছে। আমি আজ প্রেমের জন্য ফেলে যাচ্ছি আরাম- শোকার্জিত শাকান্নের জন্য ফেলে যাচ্ছি ক্রীতদাসের চর্ব্যচোষ্য জেগে থাকার জন্য ফেলে যাচ্ছি ভাত ঘুম, যন্ত্রণার জন্য ফেলে যাচ্ছি সুখ – জ্ঞানের জন্য ফেলে যাচ্ছি অন্ধতা আনন্দের জন্য ফেলে যাচ্ছি সাফল্য অমৃতের জন্য ঐশ্বর্য। আমার হাতে জ্বলছে দিশারীদের শিক্ষার মহান আগুন আমিই সেই মেয়েটি——— আপনারা নিজের দর্পণে দেখে আমাকে চিনুন আমাকে চিনুন – আমাকে চিনুন।।
০৩। বনলতা সেন – জীবাননন্দ দাশ আবৃত্তি: মোহাম্মদ রোকনুজ্জামান
বনলতা সেন
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধুসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
বেণীমাধব, বেণীমাধব, তোমার বাড়ি যাবো
বেণীমাধব, তুমি কি আর আমার কথা ভাবো?
বেণীমাধব, মোহনবাঁশি তমাল তরুমূলে
বাজিয়েছিলে, আমি তখন মালতী ইস্কুলে
ডেস্কে বসে অঙ্ক করি, ছোট্ট ক্লাসঘর
বাইরে দিদিমণির পাশে দিদিমণির বর
আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন শাড়ি
আলাপ হলো, বেণীমাধব, সুলেখাদের বাড়ি
বেণীমাধব, বেণীমাধব, লেখাপড়ায় ভালো
শহর থেকে বেড়াতে এলে, আমার রঙ কালো
তোমায় দেখে এক দৌড়ে পালিয়ে গেছি ঘরে
বেণীমাধব, আমার বাবা দোকানে কাজ করে
কুঞ্জে অলি গুঞ্জে তবু, ফুটেছে মঞ্জরী
সন্ধেবেলা পড়তে বসে অঙ্কে ভুল করি
আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন ষোল
ব্রীজের ধারে, বেণীমাধব, লুকিয়ে দেখা হলো
বেণীমাধব, বেণীমাধব, এতদিনের পরে
সত্যি বলো, সে সব কথা এখনো মনে পড়ে?
সে সব কথা বলেছো তুমি তোমার প্রেমিকাকে?
আমি কেবল একটি দিন তোমার পাশে তাকে
দেখেছিলাম আলোর নীচে; অপূর্ব সে আলো!
স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো
জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার, পুড়িয়ে দিলো চোখ
বাড়িতে এসে বলেছিলাম, ওদের ভালো হোক।
রাতে এখন ঘুমাতে যাই একতলার ঘরে
মেঝের উপর বিছানা পাতা, জ্যোৎস্না এসে পড়ে
আমার পরে যে বোন ছিলো চোরাপথের বাঁকে
মিলিয়ে গেছে, জানি না আজ কার সঙ্গে থাকে
আজ জুটেছে, কাল কী হবে? – কালের ঘরে শনি
আমি এখন এই পাড়ায় সেলাই দিদিমণি
তবু আগুন, বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই?
কেমন হবে, আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই?
০৫। বাঁশি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবৃত্তি: শিমুল মুস্তাফা
বাঁশি
কিনু গোয়ালার গলি। দোতলা বাড়ির লোহার-গরাদে-দেওয়া একতলা ঘর পথের ধারেই। লোনাধরা দেয়ালেতে মাঝে মাঝে ধসে গেছে বালি, মাঝে মাঝে স্যাঁতাপড়া দাগ। মার্কিন থানের মার্কা একখানা ছবি সিদ্ধিদাতা গণেশের দরজার 'পরে আঁটা। আমি ছাড়া ঘরে থাকে আর একটি জীব এক ভাড়াতেই, সেটা টিকটিকি। তফাত আমার সঙ্গে এই শুধু, নেই তার অন্নের অভাব॥
ধলেশ্বরী-নদীতীরে পিসিদের গ্রাম— তাঁর দেওরের মেয়ে, অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক। লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল— সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে। মেয়েটা তো রক্ষে পেলে, আমি তথৈবচ। ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া— পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর॥
বর্ষা ঘনঘোর। ট্রামের খরচা বাড়ে, মাঝে মাঝে মাইনেও কাটা যায়। গলিটার কোণে কোণে জমে ওঠে, পচে ওঠে আমের খোসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভূতি, মাছের কান্কা, মরা বেড়ালের ছানা— ছাইপাঁশ আরো কত কী যে। ছাতার অবস্থাখানা জরিমানা-দেওয়া মাইনের মতো, বহু ছিদ্র তার। আপিসের সাজ গোপীকান্ত গোঁসাইয়ের মনটা যেমন, সর্বদাই রসসিক্ত থাকে। বাদলের কালো ছায়া স্যাঁত্সেঁতে ঘরটাতে ঢুকে কলে পড়া জন্তুর মতন মূর্ছায় অসাড়! দিনরাত, মনে হয়, কোন্ আধমরা জগতের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি।
গলির মোড়েই থাকে কান্তবাবু— যত্নে-পাট-করা লম্বা চুল, বড়ো বড়ো চোখ, শৌখিন মেজাজ। কর্নেট বাজানো তার শখ। মাঝে মাঝে সুর জেগে ওঠে এ গলির বীভত্স বাতাসে— কখনো গভীর রাতে, ভোরবেলা আলো-অন্ধকারে, কখনো বৈকালে ঝিকিমিকি আলো-ছায়ায়। হঠাত্ সন্ধ্যায় সিন্ধু-বারোয়াঁয় লাগে তান, সমস্ত আকাশে বাজে অনাদি কালের বিরহবেদনা। তখনি মুহূর্তে ধরা পড়ে এ গলিটা ঘোর মিছে দুর্বিষহ মাতালের প্রলাপের মতো। হঠাত্ খবর পাই মনে, আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই। বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে ছেঁড়া ছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে এক বৈকুণ্ঠের দিকে॥
এ গান যেখানে সত্য অনন্ত গোধুলিলগ্নে সেইখানে বহি চলে ধলেশ্বরী, তীরে তমালের ঘন ছায়া— আঙিনাতে যে আছে অপেক্ষা ক'রে, তার পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর॥
মেঘ বলল যাবি?
অনেক দূরে গেরুয়া নদী
অনেক দূরের একলা পাহাড়
অনেক দূরের গহন সে বন
গেলেই দেখতে পাবি, যাবি?
জানলা দিয়ে মুখ ঝুকিয়ে
বলল সে মেঘ
যাবি? আমার সঙ্গে যাবি?
দিন ফুরিয়ে রাত ঘনাবে
রাত্রি গিয়ে সকাল হবে
নীল আকাশে উড়বে পাখি
গেলেই দেখতে পাবি, যাবি?
শ্রাবণ মাসের একলা দুপুর
মেঘ বলল যাবি? আমার সঙ্গে যাবি?
কেমন করে যাবরে মেঘ, কেমন করে যাব,
নিয়ম বাঁধা জীবন আমার
নিয়ম ঘেরা এধার ওধার
কেমন করে নিয়ম ভেঙ্গে এ জীবন হারাব
কেমন করে যাবরে মেঘ কেমন করে যাব?
মেঘ বলল দূরের মাঠে বৃষ্টি হয়ে ঝরব
সবুজ পাতায় পাতায় ভালবাসা হয়ে ঝরব
শান্ত নদীর বুকে আনব জলচ্শাসের প্রেম
ইচ্ছে মত বৃষ্টি হয়ে ভাঙব, ভেঙ্গে পরব
এই মেয়ে, তুই যাবি? আমার সঙ্গে যাবি?
যাব না মেঘ, পারব নারে যেতে
আমার আছে কাজের বাঁধন,
কাজেই থাকি মেতে
কেবল যখন ঘুমিয়ে পরি তখন আমি যাই
সীমার বাঁধন ডিঙিয়ে দৌড়ে একছুটে পালাই
তখন আমি যাই….
সবপনে আমার গেরুয়া নদী
সবপনে আমার সুনীল আকাশ
সবপনে আমার দূরের পাহাড়
সবকিছুকে পাই …
জাগরনের এই যে আমি ক্রীতদাসের মতন
জাগরনের এই যে আমি এবং আমার জীবন
কাজ অকাজের সুতোয় বোনা মুখোশ ঘেরা জীবন
তবুরে মেঘ যাব
একদিন ঠিক তোরই সঙ্গে
শ্রাবণ হাওয়ায় নতুন রঙ্গে
যাবরে মেঘ যাব
সেদিন আমি শিমুল পলাশ ভিজব বলে যাব
পাগল হাওয়ায় উতল ধারায়
আমায় খুঁজে পাব
যাবরে মেঘ যাব, যাবরে মেঘ যাব, যাবরে মেঘ যাব।
০৭। কবর – জসীমউদ্দীন আবৃত্তি: শান্ত ইসলাম
কবর
এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে, তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে। এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ, পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক। এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা, সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা! সোনালি ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি লাঙল লইয়া খেতে ছুটিলাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি। যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোরে তামাশা করিত শত। এমনি করিয়া জানি না কখন জীবনের সাথে মিশে ছোট-খাট তার হাসি ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে।
বাপের বাড়িতে যাইবার কাল কহিত ধরিয়া পা আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ। শাপলার হাটে তরমুজ বেচি দু'পয়সা করি দেড়ী, পুঁতির মালার একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি। দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে, সন্ধাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে! হেস না- হেস না- শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে, দাদি যে তোমার কত খুশি হত দেখিতিস যদি চেয়ে! নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, এতদিন পরে এলে, পথ পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখিজলে। আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়, কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝঝুম নিরালায়! হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়, আমার দাদীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়।
তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি। শত কাফনের, শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি, গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি। এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে, গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে। মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে মিশায়ে বুক, আয়-আয় দাদু, গলাগলি ধরি কেঁদে যদি হয় সুখ।
এইখানে তোর বাপজি ঘুমায়, এইখানে তোর মা, কাঁদছিস তুই? কী করিব দাদু! পরাণ যে মানে না। সেই ফালগুনে বাপ তোর এসে কহিল আমারে ডাকি, বা-জান, আমার শরীর আজিকে কী যে করে থাকি থাকি। ঘরের মেঝেতে সপটি বিছায়ে কহিলাম বাছা শোও, সেই শোওয়া তার শেষ শোওয়া হবে তাহা কী জানিত কেউ? গোরের কাফনে সাজায়ে তাহারে চলিলাম যবে বয়ে, তুমি যে কহিলা বা-জানরে মোর কোথা যাও দাদু লয়ে? তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে, সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে!
তোমার বাপের লাঙল-জোয়াল দুহাতে জঢ়ায়ে ধরি, তোমার মায়ে যে কতই কাঁদিতে সারা দিনমান ভরি। গাছের পাতার সেই বেদনায় বুনো পথে যেতো ঝরে, ফালগুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো-মাঠখানি ভরে। পথ দিয়া যেতে গেঁয়ো পথিকেরা মুছিয়া যাইত চোখ, চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক। আথালে দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি, হাম্বা রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি। গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা, চোখের জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গাঁ।
ঊদাসিনী সেই পল্লী-বালার নয়নের জল বুঝি, কবর দেশের আন্ধারে ঘরে পথ পেয়েছিল খুজি। তাই জীবনের প্রথম বেলায় ডাকিয়া আনিল সাঁঝ, হায় অভাগিনী আপনি পরিল মরণ-বিষের তাজ। মরিবার কালে তোরে কাছে ডেকে কহিল, বাছারে যাই, বড় ব্যথা র’ল, দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই; দুলাল আমার, যাদুরে আমার, লক্ষী আমার ওরে, কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে। ফোঁটায় ফোঁটায় দুইটি গন্ড ভিজায়ে নয়ন-জলে, কী জানি আশিস করে গেল তোরে মরণ-ব্যথার ছলে।
ক্ষণপরে মোরে ডাকিয়া কহিল- আমার কবর গায় স্বামীর মাথার মাথালখানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়। সেই যে মাথাল পচিয়া গলিয়া মিশেছে মাটির সনে, পরাণের ব্যথা মরে নাকো সে যে কেঁদে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে। জোড়মানিকেরা ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরু-ছায়, গাছের শাখারা স্নেহের মায়ায় লুটায়ে পড়েছে গায়। জোনকি-মেয়েরা সারারাত জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো, ঝিঁঝিরা বাজায় ঘুমের নূপুর কত যেন বেসে ভালো। হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, রহমান খোদা! আয়; ভেস্ত নসিব করিও আজিকে আমার বাপ ও মায়!
এখানে তোর বুজির কবর, পরীর মতন মেয়ে, বিয়ে দিয়েছিনু কাজিদের বাড়ি বনিয়াদি ঘর পেয়ে। এত আদরের বুজিরে তাহারা ভালবাসিত না মোটে, হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে। খবরের পর খবর পাঠাত, দাদু যেন কাল এসে দুদিনের তরে নিয়ে যায় মোরে বাপের বাড়ির দেশে। শ্বশুর তাহার কশাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে অনেক কহিয়া সেবার তাহারে আনিলাম এক শীতে। সেই সোনামুখ মলিন হয়েছে ফোটে না সেথায় হাসি, কালো দুটি চোখে রহিয়া রহিয়া অশ্রু উঠিছে ভাসি। বাপের মায়ের কবরে বসিয়া কাঁদিয়া কাটাত দিন, কে জানিত হায়, তাহারও পরাণে বাজিবে মরণ-বীণ! কী জানি পচানো জ্বরেতে ধরিল আর উঠিল না ফিরে, এইখানে তারে কবর দিয়েছি দেখে যাও দাদু! ধীরে।
ব্যথাতুরা সেই হতভাগিনীরে বাসে নাই কেহ ভালো, কবরে তাহার জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাসগুলি কালো। বনের ঘুঘুরা উহু উহু করি কেঁদে মরে রাতদিন, পাতায় পাতায় কেঁপে উঠে যেন তারি বেদনার বীণ। হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়। আমার বু-জীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়।
একদিন গেনু গজনার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে, ফিরে এসে দেখি সোনার প্রতিমা লুটায় পথের পরে। সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে। কী জানি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গেছে। আপন হস্তে সোনার প্রতিমা কবরে দিলাম গাড়ি, দাদু! ধর-ধর- বুক ফেটে যায়, আর বুঝি নাহি পারি। এইখানে এই কবরের পাশে আরও কাছে আয় দাদু, কথা কস নাকো, জাগিয়া উটিবে ঘুম-ভোলা মোর যাদু। আস্তে আস্তে খুঁড়ে দেখ দেখি কঠিন মাটির তলে, দীন দুনিয়ার ভেস্ত আমার ঘুমায় কিসের ছলে !
০৮। আমার নাম ভারতবর্ষ – অমিতাভ দাশগুপ্ত আবৃত্তি: মেধা বন্দোপাধ্যায়
আমার নাম ভারতবর্ষ
স্টেন গানের বুলেটে বুলেটে
আমার ঝাঁঝরা বুকের উপরে ফুটে উঠেছে যে মানচিত্র—
তার নাম ভারতবর্ষ।
আমার প্রতিটি রক্তের ফোঁটা দিয়ে
চা-বাগিচায় কফি খেতে,
কয়লা-খাদানে, পাহাড়ে-অরণ্যে
লেখা হয়েছে যে ভালোবাসা—
তার নাম ভারতবর্ষ।
আমার অশ্রুর জলসেচে আর হাড়ের ফসফেট-এ
খুনীর চেয়েও রুক্ষ কঠোর মাটিতে
বোনা হয়েছে যে-অন্তহীন ধান ও গানের স্বপ্ন—
তার নাম ভারতবর্ষ।
আমার ঠাণ্ডা মুখের ওপর
এখন গাঢ় হয়ে জমে আছে
ভাক্ রা নাঙ্গালের পাথুরে বাঁধের গমেভীর ছায়া।
ডিগবয়ের বুক থেকে
মায়ের দুধের মত উঠে আসা তোলো ভেসে যাচ্ছে
আমার সারা শরীর।
কপাল থেকে দাঙ্গার রক্ত মুছে ফেলে
আমাকে বুকে ক’রে তুলে নিতে এসেছে
আমেদাবাদের সুতোকলের জঙ্গী মজুর।
আমার মৃতদেহের পাহারাদার আজ
প্রতিটি হাল বহনকারী বলরাম।
প্রতিটি ধর্ষিতা আদিবাসী যুবতীর
শোক নয় ক্রোধের আগুনে
দাউ দাউ জ্বলে যাচ্ছে আমার শেষ শয্যা।
ভরাট গর্ভের মত
আকাশে আকাশে কেঁপে উঠছে মেঘ।
বৃষ্টি আসবে।
ঘাতকের স্টেনগান আর আমার মাঝবরাবর
ঝরে যাবে বরফ-গলা গঙ্গোত্রী।
আর একটু পরেই প্রতিটি মরা খাল-বিল-পুকুর
কানায় কানায় ভরে উঠবে আমার মায়ের চোখের মত।
প্রতিটি পাথর ঢেকে যাবে উদ্ভিদের সবুদ চুম্বনে।
ওড়িশির ছন্দে ভারতনাট্যমের মুদ্রায়
সাঁওতালী মাদলে আর ভাঙরার আলোড়নে
জেগে উঠবে তুমুল উত্সবের রাত।
সেই রাতে
সেই তারায় ফেটে পরা মেহফিলের রাতে
তোমরা ভুলে যেও না আমাকে
যার ছেঁড়া হাত, ফাঁসা জঠর, উপড়ে আনা কল্ জে,
ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু, রক্ত, ঘাম
মাইল-মাইল অভিমান আর ভালোবাসার নাম
. স্বদেশ
. স্বাধীনতা
. ভারতবর্ষ॥
০৯। স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো – নির্মলেন্দু গুণ আবৃত্তি: আসাদুজ্জামান নূর
স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো
একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি?’
এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না, এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না, এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না৷ তা হলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি? তা হলে কেমন ছিল শিশু পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে, ফুলের বাগানে ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হদৃয় মাঠখানি?
জানি, সেদিনের সব স্মৃতি ,মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত কালো হাত৷ তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ কবির বিরুদ্ধে কবি, মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ, বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল, উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান, মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ … ৷
হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি, শিশু পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি একদিন সব জানতে পারবে; আমি তোমাদের কথা ভেবে লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প৷ সেই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর৷ না পার্ক না ফুলের বাগান, — এসবের কিছুই ছিল না, শুধু একখন্ড অখন্ড আকাশ যেরকম, সেরকম দিগন্ত প্লাবিত ধু ধু মাঠ ছিল দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়৷ আমাদের স্বাধীনতা প্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল এই ধু ধু মাঠের সবুজে৷
কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক, লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক, পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক৷ হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে আর তোমাদের মত শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে৷ একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্যে কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের: “কখন আসবে কবি?’ “কখন আসবে কবি?’
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে, রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে অত:পর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন৷ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, হদৃয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা৷ কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী? গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম৷’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের৷
১০। শেষ পরিচয় – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবৃত্তি:
শেষ পরিচয়
একদিন তরীখানা থেমেছিল এই ঘাটে লেগে
বসন্তের নূতন হাওয়ার বেগে,
তোমরা শুধায়েছিলে মোরে ডাকি
‘পরিচয় কোনো আছে নাকি,
যাবে কোনখানে’?
আমি শুধু বলেছি,’কে জানে’!
নদীতে লাগিল দোলা,বাধঁনে পড়িল টান-
একা,বসে গাহিলাম যৌবনের বেদনার গান।
সেই গান শুনি
কুসুমিত তরুতলে তরুণ-তরুণী
তুলিল অশোক-
মোর হাতে দিয়া কহিল,’এ আমাদেরই লোক’।
আর কিছু নয়।
সে মোর প্রথম পরিচয়।
তার পরে জোয়ারের বেলা
সাঙ্গ হল, সাঙ্গ হল জোয়ারের খেলা;
কোকিলের ক্লান্ত গানে
বিস্মৃত দিনের কথা অকস্মাৎ যেন মনে আনে;
কনক চাপার দল পড়ে ঝুরে,
ভেসে যায় দূরে,
ফাল্গুণের উৎসবরাতির
নিমন্ত্রণলিখনপা তির
ছিন্ন অংশ তারা
অর্থহারা।।
ভাঁটার গভীর টানে
তরীখানা ভেসে যায় সমুদ্রের পানে।
নূতন কালের নবযাত্রী ছেলেমেয়ে
শুধাইছে দূর হতে চেয়ে,
‘সন্ধ্যার তারার দিকে
বহিয়া চলেছে তরণী কে?’
সেতারেতে বাঁধিলাম তার,
গাহিলাম আরবার,
‘মোর নাম এই’বলে খ্যাত হোক,
আমি তোমাদেরই লোক,
আর কিছু নয়-
এই হোক শেষ পরিচয়।
ঝনঝন ক’রে সৃষ্টিসুদ্ধ ভাঙচে, গড়চে, চলচে-
কোথায় তুমুল শব্দ ?
মাঝখানে তারি হঠাৎ পাগল মুখ
দেখে চেনে আয়নায়
আকাশে তাকিয়ে হাসে ।
ভরা সন্ধ্যায় চুপ ক’রে ব’সে থাকে
হারানো ছড়ানো পাগল ।
১১। বিদ্রোহী – কাজী নজরুল ইসলাম আবৃত্তি: কাজী সব্যসাচী
আমি চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস, আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর! আমি দুর্ব্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার! আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি দ'লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল! আমি মানি নাকো কোনো আইন, আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম, ভাসমান মাইন! আমি ধূর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর! আমি বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর! বল বীর – চির উন্নত মম শির!
আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণী, আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণী! আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠুমকি' ছমকি' পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি' ফিং দিয়া দিই তিন দোল্! আমি চপলা-চপল হিন্দোল!
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা', করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা! আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর। আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর। বল বীর – আমি চির-উন্নত শির!
আমি চির-দুরন্ত-দুর্ম্মদ, আমি দুর্দ্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দ্দম্ হ্যায়্ হর্দ্দম্ ভরপুর মদ। আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক, জমদগ্নি, আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি! আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান, আমি অবসান, নিশাবসান। আমি ইন্দ্রাণি-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য্য, মম এক হাতে-বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য্য। আমি কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির। আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর। বল বীর – চির উন্নত মম শির।
আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক! আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস, আমি আপনা ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ! আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার, আমি ইস্ত্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার, আমি পিনাক-পাণির ডমরু-ত্রিশূল, ধর্ম্মরাজের দন্ড, আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ-প্রচন্ড! আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র-শিষ্য, আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব! আমি প্রাণ-খোলা-হাসি উল্লাস, – আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস, আমি মহা-প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস! আমি কভু প্রশান্ত, – কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী, আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্প-হারী! আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল, আমি উজ্জ্বল আমি প্রোজ্জ্বল, আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল্ দোল!
আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি, আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম, আমি ধন্যি। আমি উন্মন মন উদাসীর, আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর! আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের, আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের! আমি অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়, চিত- চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর! আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক'রে দেখা অনুখন, আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা'র কাঁকন-চুড়ির কন্-কন্। আমি চির-শিশু, চির-কিশোর, আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর! আমি উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাসী পূরবী হাওয়া, আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীনে গান গাওয়া! আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র রবি, আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি! – আমি তুরিয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ! আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!
আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন, আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব বিজয় কেতন! ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া স্বর্গ-মর্ত্ত্য করতলে, তাজি বোরবাক্ আর উচ্চৈস্রবা বাহন আমার হিম্মত-হ্রেস্বা হেঁকে চলে! আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল, আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথর-কলরোল-কল-কোলাহল! আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ, আণি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা, সঞ্চরি' ভূমি-কম্প! ধরি বাসুকির ফনা জাপটি', – ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি'! আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল, আমি ধৃষ্ট আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী, মহা- সিন্ধু উতলা ঘুম্-ঘুম্ ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম্ মম বাঁশরী তানে পাশরি' আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী। আমি রুষে উঠে' যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া, ভয়ে সপ্ত নরক হারিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া! আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!
আমি আমি শ্রাবণ প্লাবন- বন্যা, কভু ধরণীরে করি বরণিয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা – আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা! আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি, আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণি! আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী, আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!
আমি মৃণ্ময়, আমি চিন্ময়, আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়! আমি মানব দানব দেবতার ভয়, বিশ্বের আমি চির দুর্জ্জয়, জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য, আমি তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্ত্য আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!! আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!! আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার, নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার! আমি হল বলরাম স্কন্ধে, আমি উপাড়ি' ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।
মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না – বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত! আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন, আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন! আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন! আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি চির-বিদ্রোহী বীর – আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!
টিভিওয়ালারা বইললেক
“তুমি ক্ষেতমজুরের মেইয়া
তুমি কী করে কামিন থাইকা
মাধ্যমিকে প্রথম হলে বল দেখি?
সে’টা তোমাকে বইলতা হবে খুইলা।”
পঞ্চায়েতের অনি বৌদি, পধান, উপপধান, এমএলে, এম.পি-
সব একেবারে হামলিয়ে পড়ল আমাদের মাটির কুঁইড়াঘরে।
জামবনি ইস্কুলের হেডমাস্টার
কোন বিহান বেলায় টিনের আগর খুইলে,
হাইকা, ডাইকা, ঘুম ভাঙাই- খবরটা যখন পথম শুনালেক
তখন মাকে জড়াই শুয়ে ছিলুম আমি।
কুঁইড়াঘরের ঘুটঘুইটা আঁধারে হেডমাস্টারকে দেইখে
চোখ কচালে মায়ের পারা আমিও হাঁ – হয়ে ভাইবে ছিলেম।
-একি স্বপন দেখছি নাকি-
স্যার বইলল, এটা স্বপুন লয়, স্বপুন লয়, সত্যি বটে।
কথাটো শুইনে কাঁদে ভাসায়েছিলুম আমরা মা বিটি।
আজ বাপ বাইচে থাইকলে
আমি মানুষটাকে দেখাইতে পাইত্থম। দেখাইতে পাইতত্থেম বহুত কিছু-
আমার বুকের ভিতরে
যে তেজালো সইনঝা বাতিটা জ্বালায়ে দিয়েছিল মানুষটা।
সেই বাতিটা আজকে কেমন আমাদের কুঁইড়ে ঘরটাকে আলো কইরেছে।
সেটো দেখাইতে পাইত্থম।
আপনারা বইলছেন বটে
“তুমাদের মতো মেইয়ারা যদি উঠে আসে তবে ভারতবর্ষ উঠে আসে।”
কথাটা খুবই সত্যি, কিন্তু
উঠে আসার রাস্তাটা যে এখনও তৈয়ার হয় নাই।
খাড়া পাহাড়ে উঠা যে কি জিনিস।
বহুত দম লাগে। বহুত ত্যাজ লাগে…
আমি জামবনির কুঁইরি পাড়ার শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি।
যখন থেকে হুঁশ হইছে তখন থেকে শুইনে আসছি
“বিটি না মাটি’
ঠাকুমা বইলথক্,
পরের ঘরে হেঁইসেল ঠেইলবেক্ তার আবার লিখাপড়া’
গাঁয়ের বাবুরা বইলতো
তুই কুঁইরি পারার বেটি ছিলা
তোর কামিন কাটা ছাড়া গতি কি!
বাপ বইলথক্
“দ্যাখ সাঁঝলি – মন খারাপ কইরলি তো হেইরে গেলি।
শুন যে যা বইলছে বলুক্। সে সব কথা এক কানে সিধালে
আর এক কানে বার কইরে দিবি।’
তখ্যান বাবুপাড়ার দেঘইরা ঘরে কামিন খাইটতক মা।
ক্ষয় রোগের তাড়সে-মায়ের গতরটা ভাঙে নাই অতোটা।
মাঝে মইধ্যে জ্বরটর আইত বটে, জ্বর এলে মা
চুপচাপ এঙনাতে তালাই পাইতে শুইয়ে থাইকতো।
মনে আছে সে ছিল এক জাঁড় কালের সকাল।
রোদ উঠেছিল ঝলমলানি ঝিঙা ফুলা রোদ।
আমি সে রোদে পিঠ দিয়া গা দুলাই পড়ছিলাম
ইতিহাস…
কেলাস সেভেনের সামন্ত রাজাদের ইতিহাস।
দে ঘরের গিন্নি লোক পাঠাইছিল বারকতক।
মায়ের জ্বর সে তারা শুইনতে নাই চায়!
আমাদের দিদি বুঢ়ি তখনো বাঁইচে।
ফুল তলায় বইসে
ছেঁড়া কম্বল মুড়হি দিয়ে বিড়ি ফুকছিল বুড়হি।
শেষতক্ বুড়হি সেদিন পড়া থেকে উঠাই
মায়ের কাইজ টুকুন কইরতে পাঠাই ছিল বাবু ঘরে।
পুরানো ফটক ঘেরা উঠান-অতোবড়ো দরদালান- অতোবড়ো বারান্দা,
সব ঝাঁট ফাট দিয়ে সাফ সুতরো করে আসছিলুম চইলে,
দেঘইরে গিন্নি নাই ছাইড়ল্যাক, একগাদা এটাকাটা-জুঠা বাসন
আমার সামনে আইনে ধইরে দিলেক। বইল্লুম
“আমি তোমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবো,”
বাবু গিন্নির সেকি রাগ’-
“কি বইল্লি তুই! যতবড়ো মু লয় তত বড়ো কথা? জানিস,
তর মা, তর মায়ের মা, তার মায়ের মা সবাই এতক্কাল
আমাদের জুঠা বাসন ধুয়ে গুজারে গ্যালো
আর তুই আমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবি!”
বল্লুম “হ আমি তোমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবো।
তোমরা লোক দেখে লাওগা। আমি চইল্লোম”
কথাটো বইলে গটগট গটগট কইরে বাবু গিন্নির মুখের সামনে
আমি বেড়োই চইলে আইলম।”
তা বাদে সে লিয়ে কি কাইন্ড। কি ঝাম্যালা।
বেলা ডুবলে মাহাতোদের ধান কাট্টে বাপ ঘরে ফিরে আইলে
দুপাতা লিখাপড়া করা লাত্নির ছোট মুখে বড়ো থুতির কথা
সাতকাহন কইরে বইলেছিল বুড়হি দিদি।
মা কুনো রা কাড়ে নাই।
আঘর মাসের সইন্ ঝা বেলাই এঙ্গ্নাতে আগুন জ্বেইলে
গা-হাত-পা সেঁকছিল মা।
একমাথা ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকানো বাপের পেটানো পাথরের মুখটা
ঝইলকে উঠেছিল আগুনের আঁচে।
আমি বাপের অমুন চেহারা কুনোদিন দেখি লাই।
বাপ সেদিন মা আর দিদি বুড়ির সমুখে আমাকে কাইছে ডেইকে
মাথায় হাত বুলাই গম্ গইমা গলায় বইলেছিল –
যা কইরেছিস্! বেশ্ কইরেছিস্।
শুন্, তর মা, তর মায়ের মা, তার মায়ের মা- সবাই কইরেছে কামিনগিরি।
বাবুঘরে গতর খাটাই খাইয়েছে। তাইতে হইছে টা কি।
তাতে হইছে টা কি! ই-কথাটো মনে রাখবি সাঝ্লি,
তুই কিন্তু কামিন হবার লাগে জম্মাস লাই।
যত বড় লাট সাহেবই হোক কেনে কারু কাছে মাথা নোয়াই
নিজের ত্যাজ বিকাবি লাই।
এই ত্যাজ টুকুর ল্যাইগে লিখাপড়া শিখাচ্ছি তুকে।
না হলে আমাদের মতো হা-ভাতা মানুষের ঘরে আর আছে টা কি?”
আমি জামবনির কুইরি পাড়ার শিবু কুইরির বিটি সাঁঝলি,
কবেকার সেই কেলাস সেভেনের কথা ভাবতে যায়ে
কাগজওয়ালা টিভিওয়ালাদের সামনে এখুন কি যে বলি…
তালপাতার রদ দিয়ে ঘেরা গোবুর লতার এঙ্গনাতে লুকে এখন লুকাকার।
তার মাঝে বাঁশি বাজাই, জিপগাড়িতে চেইপে
আগুপিছু পুলিশ লিয়ে মন্ত্রী আইল্যাক ছুটে।
‘কুথায় সাঁঝলি কুইরি কুথায়’, বইলতে বইলতে
বন্দুকধারী পুলিশ লিয়ে সুজা আমাদের মাটির কুইড়ে ঘরে,
হেডমাস্টার বইললে ‘পনাম কর, সাঁঝলি পনামকর’
মন্ত্রী তখন পিঠ চাপড়াইল্যাক। পিঠ চাপরাই বইল্লেক,
“তুমি কামিন খেইটে মাইধ্যমিকে পথম হইছ,
তাই তুমারে দেইখতে আইলম্, সত্যিই বড় গরীব অবস্থা বটে।
তুমাদের মতো মিয়ারা যাতে উঠে আসে
তার লাগেই তো আমাদের পার্টি, তার লাগেই তো আমাদের সরকার।
– এই লাও, দশ হাজার টাকার চেকটা এখুন লাও।
শুন আমরা তুমাকে আরো ফুল দিব, সম্মর্ধ্বনা দিব,
আরো দ্যাদার টাকা তুলে দিব।–
এই টিবির লোক, কাগুজের লোক, কারা আছেন, ই-দিকে আসেন।“
তক্ষুনি ছোট বড় কতরকমের সব ঝইলকে উঠল ক্যামেরা,
ঝইলকে উঠল মন্ত্রীর মুখ। না না মন্ত্রী লয়, মন্ত্রী লয়,
ঝইলকে উঠল আমার বাপের মুখ।
গন্ গনা আগুনের পারা আগুন মানুষের মুখ।
আমি তক্ষুনি বইলে উঠলম-
“না না ই টাকা আমার নাই লাইগব্যাক। আর আপনারা
যে আমায় ফুল দিব্যান, সম্মর্ধ্বনা দিব্যান বইলছেন তাও আমার নাই লাইগব্যাক।’
মন্ত্রী তখন ঢোক গিলল্যাক।
গাঁয়ের সেই দেঘইর্যা গিন্নির বড় ব্যাটা এখুন পাটির বড় ল্যাতা।
ভিড় ঠেলে সে আইসে বইলল্যাক-
“ক্যানে, কি হইছেরে সাঁঝলি,
তুই তো আমাদের বাড়ি কামিন ছিলি।
বল তর কি কি লাইগব্যাক, বল, তর কি কি লাইগব্যাক খুলে বল খালি,”
বইল্ লম –
“আমার পাড়া শয়ে শয়ে আর অনেক সাঁঝলি আছে।
আরো শিবু কুইরির বিটি আছে গাঁ গিরামে। তারা যদ্দিন
অন্ধকারে পইড়ে থাইকবেক তারা যদ্দিন লিখ-পড়ার লাগে কাঁইদে বুলব্যাক্।
তদ্দিন কুনো বাবুর দয়া আমার নাই লাইগব্যাক্। শুইনছ্যান আপনারা
তদ্দিন কুনো বাবুর দয়া আমার নাই লাইগ্ ব্যাক।”
১৩। বলতে নেই – শুভ দাশগুপ্ত আবৃত্তি:
বলতে নেই
সব কথা বলতে নেই-
পরস্ত্রীর সৌন্দর্যের কথা,
আর অফিসের সঠিক মাইনের কথা ,
নিজের বৌ কে বলতে নেই ।
হিন্দুদের সামনে গোমাংসের কথা বলতে নেই,
রেলের কর্তাদের সামনে;
টাইম টেবল এর কথা বলতে নেই ।
ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যপারে-
শিক্ষককে বলতে নেই,
আর পুলিশকে সততার কথা বলতে নেই
যখনই যা ইচ্ছে হলো বলে ফেলতে নেই ।
ইচ্ছে আপনার করবে
জ্বিবটা উসখুস করবে
গলার ভেতরটা কুটকুট করে উঠবে
তবু বলতে নেই ।
আপনি ভাববেন পরিকল্পনার পাঠশালায়
সব শালাই ভাওতা মারছে
ভাবতে নিশ্চয় পারেন
কিন্তু বলতে নেই ।
আপনি ভাববেন হাসপাতাল, থানা , সরকারি দপ্তরগুলো ক্রমশ ফোঁড়ে,
আর দালালদের মৃগয়া ক্ষেত্র হয়ে উঠছে ।
ভাবতে সারাদিন ধরে পারেন কিন্তু বলতে নেই।
এমনি বাজারে ছেড়ে দিলে-
কুঁড়ি টাকা রোজের মুটেগিরিও জুটত না যে বেটার!
রাজনিতির সোনার কাঠির ছোঁয়ায়
সে বেটা গাড়ি-বাড়ি করে জনগনের মাথায় চরে ব্রেকডান্স করছে।
সেসব ভেবে আপনি তেলে বেগুনে জলে চটে উঠতে পারেন-
কিন্তু বলতে নেই ।
প্রাক্তন মন্ত্রি জেলে ঢুকছেন।
পর্দার মেগা স্টারেরা কোটি কোটি টাকার ট্যাক্স ফাকি দিচ্ছে ,
আর টিভিতে মেরা দেশ মহান বলে হাসছে ।
বাংলার সিনেমা বেদের মেয়ের পাল্লায় পরে
সিঁদুর নিও না মুছে বলে আর্তনাদ করছে ।
একশ টাকার ধাউশ পুঁজ সংখ্যার উপন্যাসে
কাহিনির চেয়ে ছায়া আর ব্লাউজ এর কথা বেশি থাকছে ।
বুদ্ধিমান পরিচালক হাড়-হাবাদের জীবন নিয়ে সিনেমা তৈরি করে-
ফরেনে পুরস্কার হাতাচ্ছেন ,
আর পাচতারা হোটেলে বসে ফুর্তি মারছেন ।
খবরের কাগজে খুন, ডাকাতি আর ধর্ষণের সিরিয়াল ছাপছে-
টিভিতে মুর ঝ্যাটার বিজ্ঞাপনে উলঙ্গ মেয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ।
সব কিছুতে আপনি বিরক্ত হতে পারেন
কিন্তু বলতে নেই ।
কারখানার পর কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে-
শ্রমিকেরা বাটি হাতে ভিক্ষে করছে ,গলায় দরি দিচ্ছে ।
আর ইউনিয়নের দাদারা রান্না ঘরে টাইলস বসাচ্ছেন
সাংসদ , বিধায়করা প্রিতি ক্রিকেট ম্যাচ খেলছে
দেখে শুনে আপনার বাপের নাম খগেন হয়ে যেতে পারে
কিন্তু বলতে নেই ।
বলেছেন কি ফেসেছেন
লাল বলবে এ বেটা নিলের দলাল প্রতিক্রিয়াশিল আর
নিল বলবে ও বেটা লালের দালাল দেশদ্রহী।
মাঝখান থেকে আপনি নাকাল
আপনার ধোপা নাপিত বন্ধ হয়ে যেতে পারে
বলেছেন কি ফেসেছেন-
প্যাচে পরুন তখন বুঝবেন।
বাড়িতে চোর ঢুকে সব সাফ করে দিক
থানা বলবে বাড়িতে এত জিনিস রাখেন কেন !!
দিনকাল বোঝেন না খালি বড় বড় কতা ।
সুতরাং বলতে নেই । ।
বোবার শ্ত্রু নেই বোবা হয়ে থাকুন!
চোখে ছানি পড়লে কাটাবেন না-
দৃষ্টি যত ঝাপসা
বেচে থাকার আনন্দ ততো বেশি ।
একটা কথা সাফ বলে দেই
যে বেটা এখনও জন্মায় নি আর যে বেটা টেশে গেছে
এরা ছাড়া কোন মিয়াই সুখে নেই ।
আপনি ভ্যাব্লা না নেতা না অভিনেতা!!
না ঘরের না ঘাটের,
আপনার মশাই চুপ করে থাকাই শ্রেয়-
চুপ করে মটকা মেরে পরে থাকুন না
আর তো ক’টা দিন।
মনে মনে গান করুন-
ঐ মহা সিন্দুর ওপার থেকে কি সঙ্গিত ভেসে আসে ।
১৪। না পাঠানো চিঠি — সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আবৃত্তি: ব্রততী বন্দোপাধ্যায়
না পাঠানো চিঠি
মা, তুমি কেমন আছ?
আমার পোষা বেড়াল খুনচু সে কেমন আছে?
সে রাত্তিরে কার পাশে শোয়?
দুপুরে যেন আলি সাহেবদের বাগানে না যায়।
মা, ঝিঙে মাচায় ফুল এসেছে?
তুলিকে আমার ডুরে শাড়িটা পর়তে বোলো।
আঁচলের ফেঁসোটা যেন সেলাই করে নেয়।
তুলিকে কত মেরেছি! আর কোনদিন মারবো না।
আমি ভালো আছি। আমার জন্য চিন্তা কোরো না
মা, তোমাদের ঘরের চালে নতুন খর দিয়েছো?
এবারে বৃষ্টি হয়েছে খুব
তরফদার বাবুদের পুকুরটা কি ভেসে গেছে?
কালু-ভুলুরা মাছ পেয়েছে কিছু?
একবার মেঘের ডাক শুনে কৈ মাছ উঠে এসেছিল ডাঙায়
আমি আম গাছ তলায় দুটো কৈ মাছ ধরেছিলাম
তোমার মনে আছে, মা?
মনে আছে আলি সাহেবের বাগানের সেই নারকোল?
চুরি করে আনিনি,মাটিতে পড়েছিল, কেউ দেখেনি
নারকোল বড়ার সে স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।
আলি সাহেবের ভাই মিজান আমাকে খুব আদর করতো।
বাবা একদিন দেখতে পেয়ে চেলা কাঠ দিয়ে পিটিয়েছিল
আমাকে।
আমার কি দোষ,কেউ আদর করলে আমি না বলতে পারি?
আমার পিঠে এখনো সে দাগ আছে।
আলি সাহেবদের বাগানে আর কোনদিন যাইনি।
আমি আর কোনো বাগানেই যাই না
সেই দাগটায় হাত বুলিয়ে বাবার কথা মনে পড়ে।
বাবার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়
আমি ভালো আছি, খুব ভালো আছি
বাবা যেনো আমার জন্য একটুও না ভাবে।
তুলি কি এখনো ভুতের ভয় পায়, মা?
তুলি আর আমি পুকুর ধারে কলা বউ দেখেছিলাম
সেই থেকে তুলির ফিটের ব্যারাম শুরু হলো
দাদা সেই কলা গাছটা কেটে ফেললো
আমি কিন্তু ভয় পাই নি, তুলি কে কত ক্ষেপিয়েছি
আমার আবার মাঝরাত্রে সেই কলা বউ দেখতে ইচ্ছে করে।
হ্যাঁ, ভালো কথা, দাদা কোনো কাজ পেয়েছে?
নকুলবাবু যে বলেছিল, বহরমপুরে নিয়ে যাবে
দাদাকে বোলো আমি ওর উপরে রাগ করিনি
রাগ পুষে রাখলে মানুষের বড় কষ্ট
আমার শরীরে আর রাগ নেই,আমি আর এক ফোঁটাও কাঁদি না
মা, আমি রোজ দোকানের খাবার খাই
হোটেল থেকে দু’বেলা আমার খাবার এনে দেয়
মাংস মুখে দিই আর তুলির কথা,কালু-ভুলুর কথা মনে পড়ে
তোমাদের গ্রামে পটল পাওয়া যায় না
আমি আলু পটলের তরকারি খাই,পটল ভাজাও খাই
হোটেলে কিন্তু কখনো শাক রান্না হয় না
পুকুর পাড় থেকে তুলি আর আমি তুলে আনতাম কলমি শাক
কী ভালো, কী ভালো, বিনা পয়সায়
কোনোদিন আর কলমি শাক আমার ভাগ্যে জুটবে না|
জোর হাওয়া দিলে তাল গাছের পাতা শরশর করে
ঠিক বৃষ্টির মত শব্দ হয়।
এই ভাদ্দর মাসে তাল পাকে ডিব ডিব করে তাল পড়ে।
বাড়ির তাল গাছ দুটো আছে তো?
কালু তালের বড়া বড় ভালবাসে, একদিন বানিয়ে দিও
তেলের খুব দাম জানি,তবু একদিন দিও
আমাকে বিক্রি করে দিয়ে ছ’ হাজার টাকা পেয়েছিলে
তা দিয়ে একটা গরু কেনা হয়েছে তো?
সেই গরুটা ভালো দুধ দেয়?
আমার মতন মেয়ের চেয়ে গরুও অনেক ভালো
গরুর দুধ বিক্রি করে সংসারের সুসার হয়
গরুর বাছুর হয়, তাতেও কত আনন্দ হয়
বাড়িতে কন্যা সন্তান থাকলে কত জ্বালা
দু’বেলা ভাত দাও রে, শাড়ি দাও রে,বিয়ের জোগাড় করো রে
হাবলু, মিজান, শ্রীধর দের থাবা থেকে মেয়েকে বাঁচাও রে।
আমি কি বুঝি না? সব বুঝি
কেন আমায় বিক্রি করে দিলে তাও তো বুঝি
সে জন্যই তো আমার কোনো রাগ নেই, অভিমান নেই।
আমি তো ভালোই আছি, খেয়ে পরে আছি।
তোমরা ওই টাকায় বাড়ি ঘর সারিয়ে নিও ঠিকঠাক।
কালু-ভুলুকে ইস্কুলে পাঠিও
তুলিকে ব্রজেন ডাক্তারের ওষুধ খাইয়ো।
তুমি একটা শাড়ি কিনো, বাবার জন্য একটা ধুতি
দাদার একটা ঘড়ির সখ, তা কি ও টাকায় কুলোবে?
আমি কিছু টাকা জমিয়েছি, সোনার দুল গড়িয়েছি।
একদিন কি হলো জানো মা?
আকাশে খুব মেঘ জমে ছিল,দিনের বেলায় ঘুরঘুট্টি অন্ধকার।
মনটা হঠাৎ কেমন কেমন করে উঠলো|
দুপুরবেলা চুপি চুপি বের়িয়ে ট্রেনে চেপে বসলাম
স্টেশনে নেমে দেখি একটা মাত্র সাইকেল রিক্শা
খুব ইচ্ছে হলো,একবার বাড়িটা দেখে আসি।
রথতলার মোড়ে আসতেই কারা যেন চেঁচিয়ে উঠলো-
কে যায়? কে যায়?
দেখি যে হাবুল-শ্রীধরদের সঙ্গে তাস খেলছে দাদা
আমাকে বললো, হারামজাদী, কেন ফিরে এসেছিস?
আমি ভয় পেয়ে বললাম,ফিরে আসিনি গো, থাকতেও আসিনি
একবার শুধু দেখতে এসেছি
হাবুল বলল, এটা একটা বেবুশ্যে মাগী
কী করে জানলো বলো তো,তা কি আমার গায়ে লেখা আছে?
আর একটা ছেলে, চিনি না,বললো, ছি ছি ছি, গাঁয়ের বদনাম
হাবুল রিকশাওয়ালা কে চোখ রাঙিয়ে বললো, ফিরে যা
আমি বললাম, দাদা, আমি মায়ের জন্য ক’টা টাকা এনেছি
আর তুলির জন্য…
দাদা টেনে একটা চড় কষালো আমার গালে
আমাকে বিক্রির টাকা হকের টাকা
আর আমার রোজগারের টাকা নোংরা টাকা
দাদা সেই পাপের টাকা ছোঁবে না, ছিনিয়ে নিল শ্রীধর
আমাকে ওরা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল।
আমি তবু দাদার ওপর রাগ করিনি
দাদা তো ঠিকই করেছে,আমি তো আর দাদার বোন নই,
তোমার মেয়ে নই, তুলির দিদি নই
আমার টাকা নিলে তোমাদের সংসারের অকল্যাণ হবে
না, না আমি চাই তোমরা সবাই ভালো থাকো
গরুটা ভালো থাকুক, তালগাছ দুটো ভালো থাকুক
পুকুরে মাছ হোক, ক্ষেতে ধান হোক,ঝিঙে মাচায় ফুল ফুটুক
আর কোনোদিন ঐ গ্রাম অপবিত্র করতে যাবো না
আমি খাট-বিছানায় শুই, নীল রঙের মশারি,
দোরগোড়ায় পাপোশ আছে, দেওয়ালে মা দুর্গার ছবি
আলমারি ভর্তি কাচের গেলাশ
বনবন করে পাখা ঘোরে। সাবান মেখে রোজ চান করি
এখানকার কুকুরগুলো সারা রাত ঘেউ ঘেউ করে
তাহলেই বুঝছো, কেমন আরামে আছি আমি?
আমি আর তোমার মেয়ে নই, তবু তুমি আমার মা
তোমার আরও ছেলেমেয়ে আছে,আমি আর মা পাবো কোথায়?
সেইজন্যই তোমাকে চিঠি লিখছি, মা
তোমার কাছে একটা খুব অনুরোধ আছে
তুলিকে একটু যত্ন করো, ও বেচারি বড় দুর্বল
যতই অভাব হোক, তবু তুলিকে তোমরা…
তোমার পায়ে পড়ি মা, তুমি বাবাকে বুঝিয়ে বলো,
তুলিকেও যেন আমার মতন আরামের জীবনে না পাঠায়
যেমন করে হোক, তুলির একটা বিয়ে দিও
ওর একটা নিজস্ব ঘর সংসার, একজন নিজের মানুষ।
আর যদি কোনোরকমই ওর বিয়ে দিতে না পারো?
ওকে বলো গলায় দড়ি দিয়ে মরতে
মরলে ও বেঁচে যাবে!
না,না,না,এ কী অলক্ষুণে কথা বলছি আমি
তুলি বেঁচে থাকুক,আর সবাই বেঁচে থাকুক
তুলির বিয়ে যদি না হয় হোক
হে ভগবান,গরিবের বাড়ির মেয়ে কি বিয়ে না হলে বাঁচতে পারে না?
বিয়ে না হলেই তাকে গ্রামের সবাই ঠোকরাবে?
দু’পায়ে জোর হলে তুলি কোথাও চলে যাক
মাঠ পেরিয়ে, জলা পেরিয়ে,জঙ্গল পেরিয়ে
আরও দূরে,আরও দূরে,যেদিকে দু’চোখ যায়
এমন জায়গা নিশ্চয়ই কোথাও আছে,কোথাও না কোথাও আছে
যেখানে মানুষরা সবাই মানুষের মতন
আঁচড়ে দেয় না,কামড়ে দেয় না,গায়ে ছ্যাঁকা দেয় না,লাথি মারে না
যেখানে একটা মেয়ে,শুধু মেয়ে নয়,মানুষের মত বাঁচতে পারে
মা,তুমি আমার মা,আমি হারিয়ে গেছি
তুলিকে তুমি…তুলি যেন…আমার মতন না হয়!
১৫। স্বাধীনতা তুমি – শামসুর রাহমান আবৃত্তি:
স্বাধীনতা তুমি
স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
স্বাধীনতা তুমি
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী।
স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।
স্বাধীনতা তুমি
বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।
স্বাধীনতা তুমি
চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ।
স্বাধীনতা তুমি
কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা।
স্বাধীনতা তুমি
শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।
স্বাধীনতা তুমি
উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন।
স্বাধীনতা তুমি
বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ।
স্বাধীনতা তুমি বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার।
স্বাধীনতা তুমি
গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,
হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।
স্বাধীনতা তুমি
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,
খুকীর অমন তুলতুলে গালে
রৌদ্রের খেলা।
স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।
১৬। সাধারণ মেয়ে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবৃত্তি: ব্রততী বন্দোপাধ্যায়
সাধারণ মেয়ে
আমি অন্তঃপুরের মেয়ে,
চিনবে না আমাকে।
তোমার শেষ গল্পের বইটি পড়েছি, শরৎবাবু ,
‘বাসি ফুলের মালা’।
তোমার নায়িকা এলোকেশীর মরন দশা ধরেছিল
পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে।
পঁচিশ বছর বয়সের সংগে ছিল তার রেশারেশি—
দেখলেম তুমি মহদাশয় বটে,
জিতিয়ে দিলে তাকে।।
নিজের কথা বলি।
বয়স আমার অল্প।
একজনের মন ছুঁয়েছিল
আমার এই কাঁচা বয়সের মায়া।
তাই জেনে পুলক লাগলো আমার দেহে—-
ভুলে গিয়েছিলেম অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে আমি,
আমার মত এমন আছে হাজার হাজার মেয়ে,
অল্প বয়সের মন্ত্র তাদের যৌবনে।।
তোমাকে দোহাই দেই,
একটি সাধারন মেয়ের গল্প লেখো তুমি।
বড়ো দুঃখ তার।
তারও স্বভাবের গভীরে
অসাধারণ যদি কিছু তলিয়ে থাকে কোথাও
কেমন করে প্রমাণ করবে সে–
এমন কজন মেলে যারা তা ধরতে পারে!
কাঁচা বয়সের জাদু লাগে ওদের চোখে,
মন যায় না সত্যের খোঁজে–
আমরা বিকিয়ে যাই মরীচিকার দামে।।
কথাটা কেন উঠল তা বলি।
মনে করো, তার নাম নরেশ।
সে বলেছিল, কেউ তার চোখে পড়েনি আমার মতো।
এতবড়ো কথাটা বিশ্বাস করব যে সাহস হয় না,
না করব যে এমন জোর কই।।
একদিন সে গেল বিলেতে।
চিঠিপত্র পাই কখনো বা ।
মনে মনে ভাবি, রাম রাম, এত মেয়েও আছে সে দেশে,
এত তাদের ঠেলাঠেলি ভিড়!
আর, তারা কি সবাই অসামান্য–
এত বুদ্ধি এত উজ্জ্বলতা!
আর, তারা সবাই কি আবিষ্কার করেছে এক নরেশ সেনকে
স্বদেশে যার পরিচয় চাপা ছিল দশের মধ্যে।।
গেল মেল্’এর চিঠিতে লিখেছে,
লিজির সঙ্গে গিয়েছিল সমুদ্রে নাইতে
(বাংগালি কবির কবিতার ক লাইন দিয়ছে তুলে,
সেই যেখানে ঊর্বশী উঠছে সমুদ্র থেকে)
তার পরে বালির ‘পরে বসল পাশাপাশি—-
সামনে দুলছে নীল সমুদ্রের ঢেউ,
আকাশে ছড়ানো নির্মল সুর্যালোক।
লিজি তাকে খুব আস্তে আস্তে বললে,
‘এই সেদিন তুমি এসেছ, দুদিন পরে যাবে চ’লে—
ঝিনুকের দুটি খোলা,
মাঝখানটুকু ভরা থাক্
একটি নিরেট অশ্রুবিন্দু দিয়ে,
দুর্লভ, মূল্যহীন।‘
কথা বলবার কী অসামান্য ভঙ্গী!
সেই সঙ্গে নরেশ লিখেছে,
‘কথাগুলি যদি বানানো হয় দোশ কী,
কিন্তু চমৎকার–
হীরে-বসানো সোনার ফুল কি সত্য, তবুও কি সত্য নয়?’
বুঝিতেই পারছ
একটা তুলনার সংকেত ওর চিঠিতে একটা অদৃশ্য কাঁটার মতো
আমার বুকের কাছে বিধিয়ে দিয়ে জানায়–
আমি অত্যন্ত সাধারন মেয়ে।
মূল্যবানকে পুরো মূল্য চুকিয়ে দেই
এমন ধন নেই আমার হাতে।
ওগো, না হয় তাই হল,
না হয় ঋনীই রইলেম চিরজীবন।।
পায়ে পড়ি তোমার, একটা গল্প লেখো তুমি শরৎবাবু,
নিতান্ত সাধারন মেয়ের গল্প–
যে দূর্ভাগিনীকে দূরের থেকে পাল্লা দিতে হয়
অন্তত পাঁচ-সাতজন অসামান্যার সঙ্গে–
অর্থাৎ সপ্তরথিনীর মার।
বুঝে নিয়েছি আমার কপাল ভেঙ্গেছে,
হার হয়েছে আমার।
কিন্তু, তুমি যার কথা লিখবে
তাকে জিতিয়ে দিয়ো আমার হয়ে–
পড়তে পড়তে বুক যেন ওঠে ফুলে।
ফুলচন্দন পড়ুক তোমার কলমের মুখে।।
তাকে নাম দিয়ো মালতী
ওই নামটা আমার ।
ধরা পড়বার ভয় নেই।
এমন অনেক মালতী আছে বাংলাদেশে,
তারা সবাই সামান্য মেয়ে,
তারা ফরাসি জর্মান জানে না ,
কাঁদতে জানে।।
কী করে জিতিয়ে দেবে?
উচ্চ তোমার মন, তোমার লেখনী মহীয়সী।
তুমি হয়তো ওকে নিয়ে যাবে ত্যাগের পথে
দুঃখের চরমে, শকুন্তলার মত।
দয়া করো আমাকে।
নেমে এস আমার সমতলে।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাত্রির অন্ধকারে
দেবতার কাছে যে অসম্ভব বর মাগি
সে বর আমি পাব না,
কিন্তু পায় যেন তোমার নায়িকা।
রাখো-না কেন নরেশকে সাত বছর লন্ডনে,
বারে বারে ফেল করুক তার পরীক্ষায়,
আদরে থাক আপন উপাসিকামন্ডলীতে।
ইতিমধ্যে মালতী পাশ করুক এম.এ.
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে,
গণিতে প্রথম হোক তোমার কলমের এক আঁচড়ে।
কিন্তু, ওই খানেই যদি থামো
তোমার সাহিত্যসম্রাট নামে পড়বে কলংক।
আমার দশা যাই হোক,
খাটো কোরো না তোমার কল্পনা–
তুমি তো কৃপন নও বিধাতার মতো।
মেয়েটাকে দাও পাঠিয়ে য়ুরোপে।
সেখানে যারা জ্ঞানি, যারা বিদ্বান, যারা বীর,
যারা কবি, যারা শিল্পী, যারা রাজা,
দল বেঁধে আসুক ওর চার দিকে।
জ্যোতির্বিদের মতো আবিষ্কার করুক ওকে—
শুধু বিদুষী ব’লে নয়, নারী ব’লে;
ওর মধ্যে যে বিশ্ববিজয়ী জাদু আছে
ধরা পড়ুক তার রহস্য–মূঢ়ের দেশে নয়–
যে দেশে আছে সমজদার, আছে দরদি,
আছে ইংরেজ, জর্মন, ফরাসি।
মালতীর সম্মানের জন্য সভা ডাকা হোক-না–
বড় বড় নামজাদার সভা।
মনে করা যাক সেখানে বর্ষণ হচ্ছে মুষুলধারে চাটুবাক্য,
মাঝখান দিয়ে সে চলেছে অবহেলায়
ঢেউয়ের উপর দিয়ে যেন পালের নৌকা।
ওর চোখ দেখে ওরা করছে কানাকানি–
সবাই বলছে, ভারতবর্ষের সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রৌদ্র
মিলেছে ওর মোহিনী দৃষ্টিতে।
(এইখানে জানান্তিকে বলে রাখি,
সৃষ্টিকর্তার প্রাসাদ সত্যই আছে আমার চোখে।
বলতে হল নিজের মুখেই–
এখনো কোনো য়ুরোপীয় রসজ্ঞের
সাক্ষাৎ ঘটে নি কপালে।।)
নরেশ এসে দাঁড়াক সেই কোনে,
আর তার সেই অসামান্য মেয়ের দল।।
আর, তার পরে?
তারপরে আমার নটেশাকটি মুড়োল।
স্বপ্ন আমার ফুরোল।
হায় রে সামান্য মেয়ে,
হায় রে বিধাতার শক্তির অপব্যয়।।
১৭। আমি কিংবদন্তির কথা বলছি – আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ আবৃত্তি: আবু সায়েম দোসর
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল।
তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন
অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন
পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা,
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।
আমি উচ্চারিত সত্যের মতো
স্বপ্নের কথা বলছি।
উনুনের আগুনে আলোকিত
একটি উজ্জ্বল জানালার কথা বলছি।
আমি আমার মা’য়ের কথা বলছি,
তিনি বলতেন প্রবহমান নদী
যে সাতার জানে না তাকেও ভাসিয়ে রাখে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নদীতে ভাসতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাছের সঙ্গে খেলা করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মা’য়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনতে পারে না
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি বিচলিত স্নেহের কথা বলছি
গর্ভবতী বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলছি।
ভালোবাসা দিলে মা মরে যায়
যুদ্ধ আসে ভালোবেসে
মা’য়ের ছেলেরা চলে যায়,
আমি আমার ভাইয়ের কথা বলছি।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্তানের জন্য মরতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ভালোবেসে যুদ্ধে যেতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সূর্যকে হৃদপিন্ডে ধরে রাখতে পারে না।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন।
আমরা কি তা’র মতো কবিতার কথা বলতে পারবো,
আমরা কি তা’র মতো স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো!
তিনি মৃত্তিকার গভীরে
কর্ষণের কথা বলতেন
অবগাহিত ক্ষেত্রে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপনের কথা বলতেন
সবত্সা গাভীর মত
দুগ্ধবতী শস্যের পরিচর্যার কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
যে কর্ষণ করে তাঁর প্রতিটি স্বেদবিন্দু কবিতা
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
শস্যহীন প্রান্তর তাকে পরিহাস করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাতৃস্তন্য থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্ষুধার্ত থেকে যাবে।
যখন প্রবঞ্চক ভূস্বামীর প্রচন্ড দাবদাহ
আমাদের শস্যকে বিপর্যস্ত করলো
তখন আমরা শ্রাবণের মেঘের মত
যূথবদ্ধ হলাম।
বর্ষণের স্নিগ্ধ প্রলেপে
মৃত মৃত্তিকাকে সঞ্জীবিত করলাম।
বারিসিক্ত ভূমিতে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপন করলাম।
সুগঠিত স্বেদবিন্দুর মত
শস্যের সৌকর্য অবলোকন করলাম,
এবং এক অবিশ্বাস্য আঘ্রাণ
আনিঃশ্বাস গ্রহণ করলাম।
তখন বিষসর্প প্রভুগণ
অন্ধকার গহ্বরে প্রবেশ করলো
এবং আমরা ঘন সন্নিবিষ্ট তাম্রলিপির মত
রৌদ্রালোকে উদ্ভাসিত হলাম।
তখন আমরা সমবেত কন্ঠে
কবিতাকে ধারণ করলাম।
দিগন্ত বিদীর্ণ করা বজ্রের উদ্ভাসন কবিতা
রক্তজবার মত প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
পরভৃতের গ্লানি তাকে ভূলুন্ঠিত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
অভ্যূত্থানের জলোচ্ছ্বাস তাকে নতজানু করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
পলিমাটির সৌরভ তাকে পরিত্যাগ করবে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তিনি স্বপ্নের মত সত্য ভাষণের কথা বলতেন
সুপ্রাচীন সংগীতের আশ্চর্য ব্যাপ্তির কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
যখন কবিকে হত্যা করা হল
তখন আমরা নদী এবং সমুদ্রের মোহনার মত
সৌভ্রত্রে সম্মিলিত হলাম।
প্রজ্জ্বলিত সূর্যের মত অগ্নিগর্ভ হলাম।
ক্ষিপ্রগতি বিদ্যুতের মত
ত্রিভূবন পরিভ্রমণ করলাম।
এবং হিংস্র ঘাতক নতজানু হয়ে
কবিতার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলো।
তখন আমরা দুঃখকে ক্রোধ
এবং ক্রোধকে আনন্দিত করলাম।
নদী এবং সমুদ্রে মোহনার মত
সম্মিলিত কন্ঠস্বর কবিতা
অবদমিত ক্রোধের আনন্দিত উত্সারণ কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে তরঙ্গের সৌহার্দ থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
নিঃসঙ্গ বিষাদ তাকে অভিশপ্ত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মূক ও বধির থেকে যাবে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
আমি একগুচ্ছ রক্তজবার কথা বলছি।
আমি জলোচ্ছ্বাসের মত
অভ্যূত্থানের কথা বলছি
উত্ক্ষিপ্ত নক্ষত্রের মত
কমলের চোখের কথা বলছি
প্রস্ফুটিত পুষ্পের মত
সহস্র ক্ষতের কথা বলছি
আমি নিরুদ্দিষ্ট সন্তানের জননীর কথা বলছি
আমি বহ্নমান মৃত্যু
এবং স্বাধীনতার কথা বলছি।
যখন রাজশক্তি আমাদের আঘাত করলো
তখন আমরা প্রাচীণ সংগীতের মত
ঋজু এবং সংহত হলাম।
পর্বত শৃংগের মত
মহাকাশকে স্পর্শ করলাম।
দিকচক্রবালের মত
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলাম;
এবং শ্বেত সন্ত্রাসকে
সমূলে উত্পাটিত করলাম।
তখন আমরা নক্ষত্রপুঞ্জের মত
উজ্জ্বল এবং প্রশান্ত হলাম।
উত্ক্ষিপ্ত নক্ষত্রের প্রস্ফুটিত ক্ষতচিহ্ন কবিতা
স্পর্ধিত মধ্যাহ্নের আলোকিত উম্মোচন কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নীলিমাকে স্পর্শ করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মধ্যাহ্নের প্রত্যয়ে প্রদীপ্ত হতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্ত্রাসের প্রতিহত করতে পারে না।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি শ্রমজীবী মানুষের
উদ্বেল অভিযাত্রার কথা বলছি
আদিবাস অরণ্যের
অনার্য সংহতির কথা বলছি
শৃংখলিত বৃক্ষের
উর্দ্ধমুখী অহংকারের কথা বলছি,
আমি অতীত এবং সমকালের কথা বলছি।
শৃংখলিত বৃক্ষের উর্দ্ধমুখী অহংকার কবিতা
আদিবাস অরণ্যের অনার্য সংহতি কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
যূথভ্রষ্ট বিশৃংখলা তাকে বিপর্যস্ত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
বিভ্রান্ত অবক্ষয় তাকে দৃষ্টিহীন করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম হীনমন্য থেকে যাবে।
যখন আমরা নগরীতে প্রবেশ করলাম
তখন চতুর্দিকে ক্ষুধা।
নিঃসঙ্গ মৃত্তিকা শস্যহীন
ফলবতী বৃক্ষরাজি নিস্ফল
এবং ভাসমান ভূখন্ডের মত
ছিন্নমূল মানুষেরা ক্ষুধার্ত।
যখন আমরা নগরীতে প্রবেশ করলাম
তখন আদিগন্ত বিশৃংখলা।
নিরুদ্দিষ্ট সন্তানের জননী শোকসন্তপ্ত
দীর্ঘদেহ পুত্রগণ বিভ্রান্ত
এবং রক্তবর্ণ কমলের মত
বিস্ফোরিত নেত্র দৃষ্টিহীন।
তখন আমরা পূর্বপুরুষকে
স্মরণ করলাম।
প্রপিতামহের বীর গাঁথা
স্মরণ করলাম।
আদিবাসী অরণ্য এবং নতজানু শ্বাপদের কথা
স্মরণ করলাম।
তখন আমরা পর্বতের মত অবিচল
এবং ধ্রুবনক্ষত্রের মত স্থির লক্ষ্য হলাম।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি স্থির লক্ষ্য মানুষের
সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কথা বলছি
শ্রেণীযুদ্ধের অলিন্দে
ইতিহাসের বিচরণের কথা বলছি
আমি ইতিহাস এবং স্বপ্নের কথা বলছি।
স্বপ্নের মত সত্যভাষণ ইতিহাস
ইতিহাসের আনন্দিত অভিজ্ঞান কবিতা
যে বিনিদ্র সে স্বপ্ন দেখতে পারে না
যে অসুখী সে কবিতা লিখতে পারে না।
যে উদ্গত অংকুরের মত আনন্দিত
সে কবি
যে সত্যের মত স্বপ্নভাবী
সে কবি
যখন মানুষ মানুষকে ভালবাসবে
তখন প্রত্যেকে কবি।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি বিচলিত বর্তমান
এবং অন্তিম সংগ্রামের কথা বলছি।
খন্ডযুদ্ধের বিরতিতে
আমরা ভূমি কর্ষণ করেছি।
হত্যা এবং ঘাতকের সংকীর্ণ ছায়াপথে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপন করেছি।
এবং প্রবহমান নদীর সুকুমার দাক্ষিণ্যে
শস্যের পরিচর্যা করছি।
আমাদের মুখাবয়ব অসুন্দর
কারণ বিকৃতির প্রতি ঘৃণা
মানুষকে কুশ্রী করে দ্যায়।
আমাদের কণ্ঠস্বর রূঢ়
কারণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ
কণ্ঠকে কর্কশ করে তোলে।
আমাদের পৃষ্ঠদেশে নাক্ষত্রিক ক্ষতচিহ্ন
কারণ উচ্চারিত শব্দ আশ্চর্য বিশ্বাসঘাতক
আমাদেরকে বারবার বধ্যভূমিতে উপনীত করেছে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমার সন্তানেরা
আমি তোমাদের বলছি।
যেদিন প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ
সূর্যের মত সত্য হবে
সেই ভবিষ্যতের কথা বলছি,
সেই ভবিষ্যতের কবিতার কথা বলছি।
আমি বিষসর্প প্রভুদের
চির প্রয়াণের কথা বলছি
দ্বন্দ্ব এবং বিরোধের
পরিসমাপ্তির কথা বলছি
সুতীব্র ঘৃণার
চূড়ান্ত অবসানের কথা বলছি।
আমি সুপুরুষ ভালবাসার
সুকণ্ঠ সংগীতের কথা বলছি।
যে কর্ষণ করে
শস্যের সম্ভার তাকে সমৃদ্ধ করবে।
যে মত্স্য লালন করে
প্রবহমান নদী তাকে পুরস্কৃত করবে।
যে গাভীর পরিচর্যা করে
জননীর আশীর্বাদ তাকে দীর্ঘায়ু করবে।
যে লৌহখন্ডকে প্রজ্জ্বলিত করে
ইস্পাতের তরবারি তাকে সশস্ত্র করবে।
দীর্ঘদেহ পুত্রগণ
আমি তোমাদের বলছি।
আমি আমার মায়ের কথা বলছি
বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
ভাইয়ের যুদ্ধের কথা বলছি
আমি আমার ভালবাসার কথা বলছি।
আমি কবি এবং কবিতার কথা বলছি।
সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা
সুপুরুষ ভালবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা
রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।
আমরা কি তাঁর মত কবিতার কথা বলতে পারবো
আমরা কি তাঁর মত স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো।
এতটা দিন পেরিয়ে আজো মায়ের জন্য কাঁদি
কারণ আমার মা যে ছিল ভীষণ মিথ্যাবাদী।
বাবা যেদিন মারা গেল আমরা হলাম একা
সেদিন থেকেই বাঁক নিয়েছে মায়ের কপাল রেখা।
মা বলতো বাবা নাকি তারার ভিড়ে আছে
লেখাপড়া করি যদি নেমে আসবে কাছে।
তারায় তারায় বাবা খুঁজি তারার ছড়াছড়ি
আমার মায়ের মিথ্যে বলার প্রথম হাতে খড়ি।
পাড়া পড়শী বলল এসে এই বয়সেই রাঢ়ি !
একা একা এতটা পথ কেমনে দিবে পাড়ি।
ভাল একটা ছেলে দেখে বিয়ে কর আবার
মা বলল, ওসব শোনে ঘিন্না লাগে আমার।
একা কোথায় খোকন আছে, বিয়ের কী দরকার
ওটা ছিল আমার মায়ের চরম মিথ্যাচার।
রাত্রি জাগে সেলাই মেশিন, চোখের কোণে কালি
নতুন জামায় ঘর ভরে যায় মায়ের জামায় তালি।
ঢুলু ঢুলু ঘুমের চোখে সুই ফুটে মা’র হাতে
আমি বলি শোও তো এবার কী কাজ অত রাতে?
মা বলত ঘুম আসে না শুয়ে কী লাভ বল?
ওটা ছিল আমার মায়ের মিথ্যা কথার ছল।
স্কুল থেকে নিতে আসা গাড়ী ঘোড়ার চাপে
আমার জন্য দাড়ানো মা কড়া রোদের তাপে।
ঘামে মায়ের দম ফেটে যায়, দুচোখ ভরা ঝিম
ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে আমায় দিত আইসক্রিম।
মায়ের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলতাম একটু নাও
মলিন হেসে মা বলত খাও তো বাবা খাও।
আমার আবার গলা ব্যাথা, ঠান্ডা খাওয়া মানা
ওটা ছিল আমার মায়ের নিঠুর মিথ্যাপনা।
বড় হয়ে চাকুরী নিয়ে শহর বড় শহর আসি
টুকটুকে বউ ঘরে আমার বউকে ভালবাসি।
পশ এলাকায় বাসা নিয়ে ডেকোরেটর ধরে
সাজিয়ে নিলাম মনের মত অত্যাধুনিক করে।
মা তখনো মফস্বলে কুশিয়ারার ঢালে
লোডশেডিং এর অন্ধকারে সন্ধ্যা বাতি জ্বালে।
নিয়ন বাতির ঢাকা শহর আলোয় ঝলমল
মাকে বলি গঞ্জ ছেড়ে এবার ঢাকা চল।
মা বলল এই তো ভাল খোলা মেলা হাওয়া
কেন আবার তোদের ওই ভিড়ের মধ্যে যাওয়া?
বদ্ধ ঘরে থাকলে আমার হাঁপানি ভাব হয়
ওটা ছিল আমার মায়ের মিথ্যা অভিনয়।
তারপর আমি আরো বড় , স্টেটস এ অভিবাসী
বিশ্ব ব্যাংকের বিশেষজ্ঞ সুনাম রাশি রাশি।
দায়িত্বশীল পদে আমার কাজের অন্ত নাই
মায়ের খবর নিব এমন সময় কমই পাই্
মা বিছানায় একলা পড়া খবর এল শেষে
এমন অসুখ হয়েছে যার চিকিৎসা নেই দেশে।
উড়ে গেলাম মায়ের কাছে অনেক দূরের পথ
পায়ে পড়ে বলি মাকে এবার ফিরাও মত
একা একা গঞ্জে পড়ে কী সুখ তোমার বল ?
আমার সংগে এবার তুমি এমেরিকা চল।
এসব অসুখ এমেরিকায় কোন ব্যাপার নয়
সাত দিনের চিকিৎসাতেই সমুল নিরাময়।
কষ্ট হাসি মুখে এনে বলল আমার মা
প্লেনে আমার চড়া বারণ তুই কি জানিস না ?
আমার কিছু হয় নি তেমন ভা্বিস অযথা
ওটাই ছিল আমার মায়ের শেষ মিথ্যা কথা।
ক’দিন পরেই মারা গেল নিঠুর মিথ্যাবদী
মিথ্যাবাদী মায়ের জন্য আজো আমি কাঁদি।
১৯। সোনার তরী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবৃত্তি:
সোনার তরী
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা–
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু-ধারে–
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে,
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও,
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।
যত চাও তত লও তরণী-‘পরে।
আর আছে?– আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে–
এখন আমারে লহ করুণা করে।
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই– ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি–
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।
আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই,
আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে-
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?
বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে,
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।
এই রক্তমাখা মটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো।
জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার।
আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।
এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আড়ষ্ট কুমারী জননী,
স্বাধীনতা, -একি তবে নষ্ট জন্ম?
একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল?
এ চোখে ঘুম আসে না। সারারাত আমার ঘুম আসে না-
তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার,
নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ,
মুন্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বিভৎস শরীর
ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারিনা, আমি
ঘুমুতে পারিনা-
রক্তের কাফনে মোড়া কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে
সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা।
স্বাধীনতা, সে আমার স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন-
স্বাধীনতা, সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।
ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।
২১। কাজলা দিদি – যতীন্দ্রমোহন বাগচী আবৃত্তি: মিমি
কাজলা দিদি
বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই
মাগো, আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুর ধারে, নেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাই জ্বলে,
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, একলা জেগে রই;
মাগো, আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?
সেদিন হতে দিদকে আর কেনই-বা না ডাকো,
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?
খাবার খেতে আসি যখন দিদি বলে ডাকি, তখন
ও-ঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো,
আমি ডাকি, – তুমি কেন চুপটি করে থাকো?
বল মা, দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে?
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল-বিয়ে হবে!
দিদির মতন ফাঁকি দিয়ে আমিও যদি লুকোই গিয়ে-
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে?
আমিও নাই দিদিও নাই কেমন মজা হবে!
ভুঁইচাঁপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল,
মাড়াস নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল;
ডালিম গাছের ডালের ফাঁকে বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে,
দিস না তারে উড়িয়ে মা গো, ছিঁড়তে গিয়ে ফল;
দিদি এসে শুনবে যখন, বলবে কী মা বল!
বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই
এমন সময়, মাগো, আমার কাজলা দিদি কই?
বেড়ার ধারে, পুকুর পাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোঁপে-ঝাড়ে;
নেবুর গন্ধে ঘুম আসে না- তাইতো জেগে রই;
রাত হলো যে, মাগো, আমার কাজলা দিদি কই?
২২। ছাড়পত্র – সুকান্ত ভট্টাচার্য আবৃত্তি: শান্ত ইসলাম
ছাড়পত্র
যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুম:
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে।
খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।
সে ভাষা বোঝে না কেউ,
কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।
আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা
পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের—
পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর
অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব— তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস॥
২৩। আবার আসিব ফিরে – জীবনানন্দ দাশ আবৃত্তি: প্রাগনা লাবনী
আবার আসিব ফিরে
আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ির তীরে — এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় — হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঠাঁলছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হব — কিশোরীর — ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে-ভেসে;
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়;
২৪। শেষের কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবৃত্তি: সৌমিত্র
শেষের কবিতা
কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?
তারি রথ নিত্য উধাও।
জাগিছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন
চক্রে পিষ্ট আধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।
ওগো বন্ধু,
সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল
তুলে নিল দ্রুতরথে
দু’সাহসী ভ্রমনের পথে
তোমা হতে বহু দূরে।
মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম
আজি নব প্রভাতের শিখর চুড়ায়;
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম।
ফিরিবার পথ নাহি;
দূর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।
কোনদিন কর্মহীন পূর্ণো অবকাশে
বসন্তবাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
ঝরা বকুলের কান্না ব্যাথিবে আকাশ,
সেইক্ষণে খুজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে
তোমার প্রাণের প্রানে, বিস্মৃতি প্রাদোষে
হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নে মুরতি।
তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
সব চেয়ে সত্য মোর সেই মৃত্যুঞ্জয় –
সে আমার প্রেম।
তারে আমি রাখিয়া এলাম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে।
পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে
কালের যাত্রায়।
হে বন্ধু বিদায়।
তোমায় হয় নি কোন ক্ষতি।
মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃতমুরতি
যদি সৃষ্টি করে থাক তাহারি আরতি
হোক তবে সন্ধ্যা বেলা-
পূজার সে খেলা
ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে;
তৃষার্ত আবেগবেগে
ভ্রষ্ট্র নাহি হবে তার কোন ফুল নৈবদ্যের থালে।
তোমার মানস ভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর ত’ষায়
তার সাথে দিব না মিশায়ে
যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।
আজও তুমি নিজে
হয়তো বা করিবে বচন
মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নবিষ্ট তোমার বচন
ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়।
হে বন্ধু বিদায়।
মোর লাগি করিয় না শোক-
আমার রয়েছে কর্ম রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই,
শুন্যেরে করিব পূর্ণো, এই ব্রত বহিব সদাই।
উ’কন্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সে ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপখক হতে আনি
রজনী গন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে
সে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালমন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।
তোমারে যা দিয়েছিনু তার
পেয়েছ নিশেষ অধিকার।
হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করূন মুহূর্তগুলি গন্ডুষ ভরিয়া করে পান
হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম,
ওগো নিরূপম,
হে ঐশ্বর্যবান
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান,
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।
২৫। ভাত দে হারামজাদা – রফিক আজাদ আবৃত্তি:
ভাত দে হারামজাদা
ভীষন ক্ষুধার্ত আছিঃ উদরে, শারীরবৃত্ত ব্যেপে
অনুভূত হতে থাকে – প্রতিপলে – সর্বগ্রাসী ক্ষুধা
অনাবৃষ্টি যেমন চরিত্রের শস্যক্ষেত্রে জ্বেলে দেয়
প্রভূত দাহন – তেমনি ক্ষুধার জ্বালা, জ্বলে দেহ
দু’বেলা দু’মুঠো পেলে মোটে নেই অন্য কোনও দাবি
অনেক অনেক-কিছু চেয়ে নিয়েছে, সকলেই চায়ঃ
বাড়ি, গাড়ী, টাকাকড়ি- কারো বা খ্যাতির লোভ আছে;
আমার সামান্য দাবিঃ পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর-
ভাত চাই-এই চাওয়া সরাসরি – ঠান্ডা বা গরম,
সরূ বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চাল হ’লে
কোনো ক্ষতি নেই মাটির শানকি ভর্তি ভাত চাইঃ
দু’বেলা দু’মুঠো পেলে ছেড়ে দেবো অন্য সব দাবি!
অযৌক্তিক লোভ নেই, এমনকি নেই যৌন ক্ষুধা-
চাইনি তো নাভিনিম্নে পড়া শাড়ি, শাড়ির মালিক;
যে চায় সে নিয়ে যাক – যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে দাও –
জেনে রাখোঃ আমার ও সব এ কোনও প্রয়োজন নেই।
যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবি,
তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কান্ড ঘটে যাবে;
ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন-কানুন –
সমুখে যা পাবো খেয়ে নেবো অবলীলাক্রমে;
যদি বা দৈবাৎ সম্মুখে তোমাকে, ধর, পেয়ে যাই –
রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপাচার হবে।