প্যারিসে বিদ্রূপ সাময়িকী শার্লি এবডোর কার্যালয়ে প্রবেশ করে গুলি চালিয়ে ১২ জনকে হত্যা করল তিন বন্দুকধারী। পরের দু’দিনে এই গ্রুপের হাতে নিহত হলেন আরও ৫ জন। ফ্রান্স একে বাকস্বাধীনতার ওপর আক্রমণ বলে আখ্যা দিল। প্যারিসে হলো বিশ্বনেতাদের অভূতপূর্ব এক সংহতি সমাবেশ। এতে সব ধর্মের নেতারা অংশ নিলেন। বেশ কয়েকটি দেশে ‘আমিই শার্লি’ বলে মিছিল সমাবেশ হলো। গত এক সপ্তাহের চিত্র ছিল এটি। জঙ্গিরা ছিল মুসলমান। ফলে গত সপ্তাহটি ছিল মুসলমানদের জন্য বেশ বিব্রতকর।
হামলাকারী দুই ভাই শরিফ কোয়াচি ও সাইদ কোয়াচি
বুধবার, ৭ জানুয়ারি, ২০১৫ মুখোশ পরা বন্দুকধারীদের হামলায় প্যারিসে সাময়িকীটির কার্যালয়ে ফ্রান্সের বিতর্কিত ব্যঙ্গাত্মক ম্যাগাজিন শার্লি এবডোর প্রধান সম্পাদকসহ ১২ জন নিহত হয়েছেন। ২০০৬ সালে মহানবীর (সা.) ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের পর থেকে সাময়িকীটির কার্যালয়ে এটি দ্বিতীয় হামলা। বন্দুকধারীরা সাময়িকীটির কার্যালয়ে হামলায় কালাশনিকভ রাইফেলের পাশাপাশি রকেট লঞ্চারও ব্যবহার করে। ফরাসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হামলায় ১২ জন নিহত ও সাতজন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে সাময়িকীর প্রধান সম্পাদক স্টেফানে শারবোনিয়ের (শার্ব) এবং তিন কার্টুনিস্ট কাবু, টিগনাস ও ওলিনস্কি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে দু’জন পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন হামলায় তিনজন অংশ নিয়েছিল। উল্লেখ্য, ফরাসি সাপ্তাহিক রম্য পত্রিকা ‘শার্লি এবদো’র বৈশিষ্ট হচ্ছে কার্টুন, প্রতিবেদন আর কৌতুক দিয়ে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, ধর্ম ও রাজনীতির সমালোচনা করা। ফ্রান্সের বিতর্কিত এ সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনটি ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে মহানবী (সা.)-এর ব্যঙ্গাত্মক কয়েকটি কার্টুন ছেপে বিতর্কে জড়িয়েছিল।
তিন হামলাকারীর মধ্যে দুজন আলজেরীয় বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিক। তারা দুই ভাই শরিফ কোয়াচি ও সাইদ কোয়াচি। শার্লি এবদোর হামলার ঘটনার পর থেকেই কোয়াচি সহোদরদের খোঁজে সাঁড়াশি অভিযানে নামে ফরাসী নিরাপত্তা বাহিনী। শুক্রবার, ৯ জানুয়ারি আবারো একটি গাড়ি ছিনতাই করে পালানোর সময় পুলিশ তাদের খোঁজ পায় । পুলিশের সাথে গুলি বিনিময়ের পর, প্যারিসের ডামার্টি এন গল শহরতলির এক প্রিন্টিং প্রেসে আশ্রয় নেয় দু’ভাই। জিম্মি করে এক কর্মীকে। শুরু হয় শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান। প্রায় একই সময়ে, প্যারিসের পূর্বাঞ্চলের কোশার সুপারমার্কেটে শুরু হয় আরেক জিম্মি নাটক। ওই তিনজনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এক জঙ্গি এক নারী পুলিশকে গুলি করে হত্যা করে। সে ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের একটি সুপার মার্কেটে কয়েকজনকে জিম্মি করে হুমকি দেয়, কোয়াচি ভাইদের ওপর হামলা হলে হত্যা করা হবে তাদের। ডামার্টি এন গলের অভিযানে দুই ভাই নিহত হওয়ার পরই সুপার মার্কেটে অভিযান চালায় ফরাসি নিরাপত্তা বাহিনী। এসময় হামলাকারীদের একজন, আমেদি কাউলিবেলি পুলিশের গুলিতে মারা গেলেও, পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় তার সঙ্গী হায়াত বোমেদিন । এর আগেই অবশ্য হামলাকারীর গুলিতে প্রাণ হারায় চার জিম্মি।
বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের তথ্য অনুযায়ী প্যারিসে হামলার দায় স্বীকার করেছে আল কায়েদার ইয়েমেন শাখা। মুসলমানদের ওপর আগ্রাসন বন্ধ না হলে সামনে আরো ভয়াবহ হামলার হুমকিও দিয়েছে জঙ্গি সংগঠনটি। ভয়াবহ হামলার পরও পরবর্তী সংখ্যাটি বের করতে পুরোদমে কাজ শুরু করেছেন শার্লি এবডোর কর্মীরা।তারা সন্ত্রাসের কাছে মাথা নত না করার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
জনসমুদ্র প্যারিস
প্যারিসে সমাবেশে যোগ দেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা
প্যারিসে ব্যঙ্গ ম্যাগাজিন শার্লি এবদো অফিসে বুধবার ১২ জনসহ তিন দিনের সন্ত্রাসী হামলায় ফ্রান্সে মোট ১৭ জন নিহত হওয়ার পর সন্ত্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে নিন্দা ও দেশটির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে ১১ জানুয়ারি রোববার প্যারিসে সমাবেশে যোগ দেন বিশ্বের কমপক্ষে ৪০টি দেশের নেতারা। এ সমাবেশে উপস্থিত হন প্রায় ১০ লাখ মানুষ। ফ্রান্সের বেশির ভাগ শহরে হাজার হাজার মানুষ সন্ত্রাসের প্রতিবাদ জানিয়ে মৌন মিছিল করেন। শনিবারের সমাবেশে দেশটির সাত লাখ মানুষ অংশ নেন। খবর এএফপি, রয়টার্স। সমাবেশে যোগ দেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল, ফিলিস্তিন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, মালির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম বাউবেকার কেইতা, নাইজারের প্রেসিডেন্ট মাহামাদাউ ইসুফোউ, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভুতোগলু, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক, ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টোলটেনবার্গ ও জর্ডানের রাজা-রানীসহ মোট ৪০টি দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও কর্মকর্তারা। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন না। তার অনুপস্থিত থাকার কথা অবশ্য আগেই হোয়াইট হাউস থেকে জানানো হয়েছিল। সমাবেশে আগতরা স্থানীয় সময় বিকেল ৩টায় মিছিল সহকারে দ্য লা রিপাবলিক ত্যাগ করেন।
পরবর্তীতে এরই রেশ ধরে বেলজিয়াম পুলিশের গুলিতে নিহত হয় দুই জঙ্গি। ফ্রান্সের ব্যঙ্গ ম্যাগাজিন শার্লি এবদোর পর এবার হামলার শিকার হলো জার্মানির হামবুর্গ থেকে প্রকাশিত একটি সংবাদপত্র। রোববার পত্রিকাটির অফিসে আগুনে বোমা হামলায় অফিসে রক্ষিত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পুড়ে যায়। এতে অবশ্য হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ফ্রান্সে রক্তপাতের ঘটনাটি ইউরোপে উপর্যুপরি সন্ত্রাসী হামলার সূচনা বলে আশঙ্কা করেছে মার্কিন গোয়েন্দারা। আড়ি পেতে ইসলামিক স্টেটস নেতাদের যোগাযোগ বার্তা জেনে এ আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে।
ফের ব্যঙ্গচিত্র, ‘শার্লি এবদো’র চাহিদা ৩০ লক্ষ
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-র চোখে এক ফোঁটা জল। হাতে ধরা একটি কাগজ, লেখা “জ্য স্যুই শার্লি (আমিও শার্লি)।” শিরোনামের ঠিক নীচেই লেখা, “তু এ পার্দোন (সব ক্ষমা করলাম)।” বুলেটের জবাব এ ভাবেই দিয়েছে শার্লি এবদো। ১৪ জানুয়ারি ২০১৫, বুধবার ফ্রান্সের প্যারিসে ব্যঙ্গাত্মক ম্যাগাজিন শার্লি এবদোর এ সপ্তাহের সংখ্যার প্রচ্ছদে সাদা পাগড়ি পরিহিত ও কান্নারত অবস্থায় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে আঁকা ব্যঙ্গচিত্রটি প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকাটির গ্রাহক সংখ্যা ৬০ হাজার। কিন্তু এই সংখ্যাটি নেওয়ার জন্য সারা বিশ্ব থেকে প্রায় ৩০ লক্ষ আবেদন ইতিমধ্যেই জমা পড়ে গিয়েছে। এদিকে শার্লি এবদোর নতুন সংখ্যার প্রচ্ছদ পক্ষে ও বিপক্ষে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিচ্ছে।
সূত্র: দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা, BBC