বাংলা বানানের নিয়ম |
তৎসম
শব্দ
বানানের
সাধারণ অপরিবর্তনীয়তা
তৎসম অর্থাৎ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত অবিকৃত সংস্কৃত শব্দের বানান যথাযথ ও
অপরিবর্তিত থাকবে৷ কারণ এইসব শব্দের বানান ও ব্যাকরণগত প্রকরণ ও পদ্ধতি
নির্দিষ্ট রয়েছে৷
ই/ঈ বা উ/ঊ
- যে-সব তৎসম শব্দে ই/ঈ বা উ/ঊ উভয় শুদ্ধ সেইসব
শব্দে
কেবল ই বা উ এবং তার কার-চিহ্ন ি বা ু ব্যবহৃত হবে৷ যেমন: অটবি, আবলি,
উর্ণা, উষা, কলশি, কিংবদন্তি, কুটির, খঞ্জনি, চিত্কার, ত্রুটি, ধমনি,
ধূলি, পঞ্জি, পদবি, পেশি, ভঙ্গি, মঞ্জরি, মসি, লহরি, রচনাবলি, সরণি,
সূচিপত্র৷
- তবে বহুল প্রচলিত বলে কিছু শব্দে ঈ-কার বজায়
থাকবে।
যেমন: গাভী, পল্লী, রানী, শ্রেণী।
- শব্দের ী (ঈ-কার) তৎসম হলে বজায় থাকবে, কিন্তু
শব্দটির
তদ্ভব রূপের ক্ষেত্রে ি (ই-কার) লিখতে হবে। যেমন: তৎসমতে পক্ষী, কিন্তু
তদ্ভবতে পাখি। এছাড়াও যেমন: হস্তী --> হাতি, বাটী -->
বাড়ি, ইত্যাদি।
রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব
রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না৷ যেমন: অর্চনা, অর্জন, অর্থ, অর্ধ,
কর্দম, কর্তন, কর্ম, কার্য, গর্জন, মূর্ছা, কার্তিক, বার্ধক্য, বার্তা,
সূর্য৷
ং
- সন্ধির ক্ষেত্রে ক খ গ ঘ পরে থাকলে পদের
অন্তস্থিত ম্
স্থানে অনুস্বার (ং) লেখা যাবে৷ যেমন: অহংকার, ভয়ংকর, সংগীত, শুভংকর,
হৃদয়ংগম, সংঘটন৷
- তবে অঙ্ক, অঙ্গ, আকাঙ্ক্ষা, গঙ্গা, বঙ্গ, লঙ্ঘন,
সঙ্গ,
সঙ্গী, প্রভৃতি সন্ধিবদ্ধ নয় বলে ঙ স্থানে ং হবে না৷
তদ্ভব,
দেশী,
বিদেশী, ও
মিশ্র শব্দ
ই
ঈ উ ঊ
- সকল অতৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, বা মিশ্র
শব্দে
কেবল ই এবং উ এবং এদের -কার চিহ্ন ি ু ব্যবহৃত হবে ৷ এমনকি স্ত্রীবাচক ও
জাতিবাচক ইত্যাদি শব্দের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে৷ যেমন: গাড়ি,
চুরি, দাড়ি, বাড়ি, ভারি (অত্যন্ত অর্থে), শাড়ি, তরকারি, বোমাবাজি,
দাবি, হাতি, বেশি, খুশি, হিজরি, আরবি, ফারসি, ফরাসি, বাঙালি, ইংরেজি,
জাপানি, জার্মানি, ইরানি, হিন্দি, সিন্ধি, ফিরিঙ্গি, সিঙ্গি, ছুরি, টুপি,
সরকারি, মাস্টারি, মালি, পাগলামি, পাগলি, দিঘি, কেরামতি, রেশমি, পশমি,
পাখি, ফরিয়াদি, আসামি, বেআইনি, ছড়ি, কুমির, নানি, দাদি, বিবি, মমি,
চাচি, মাসি, পিসি, দিদি, বুড়ি, ছুঁড়ি, নিচ, নিচু, ইমান, চুন, পুব, ভুখা,
মুলা, পুজো, উনিশ, উনচল্লিশ৷
- অনুরূপভাবে, -আলি প্রত্যয়যুক্ত শব্দে ই-কার হবে৷
যেমন:
খেয়ালি, বর্ণালি, মিতালি, সোনালি, হেঁয়ালি৷
- তবে কোনো কোনো স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে ঈ-কার
দেওয়া
যেতে পারে৷ যেমন: রানী, পরী, গাভী৷
- সর্বনাম পদরূপে এবং বিশেষণ ও ক্রিয়া-বিশেষণ
পদরূপে কী
শব্দটি যেমন: কী করছো? কী পড়ো? কী খেলে? কী আর বলব? কী জানি? কী যে করি!
এটা কী বই (অর্থাৎ এটা কীসের বই)? কী করে যাব? কী বুদ্ধি নিয়ে এসেছিলে?
কী আনন্দ! কী দুরাশা!
- অন্য ক্ষেত্রে অব্যয় পদরূপে ই-কার দিয়ে কি
শব্দটি
লেখা হবে৷ যেমন: তুমিও কি যাবে? সে কি এসেছিল? কি বাংলা কি ইংরেজি উভয়
ভাষায় তিনি পারদর্শী৷
- পদাশ্রিত নির্দেশক টি-তে ই-কার হবে৷ যেমন:
ছেলেটি,
লোকটি, বইটি৷
ক্ষ
খির, খুর ও খেত না লিখে সংস্কৃত মূল অনুসরণে ক্ষীর, ক্ষুর ও ক্ষেত-ই লেখা
হবে৷ তবে অতৎসম শব্দ খুদ, খুদে, খুর, খেপা, খিধে, ইত্যাদি লেখা হবে৷
মূর্ধন্য ণ, দন্ত্য ন
- তৎসম শব্দের বানানে ণ, ন-য়ের নিয়ম ও শুদ্ধতা
রক্ষা
করতে হবে৷ এ-ছাড়া তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র কোনো শব্দের বানানে ণ
ব্যবহার করা হবে না৷ যেমন: অঘ্রান, ইরান, কান, কোরান, গুনতি, গোনা, ঝরনা,
ধরন, পরান, সোনা, হর্ন৷
- তৎসম শব্দে ট ঠ ড ঢ-য়ের পূর্বে যুক্ত নাসিক্য
বর্ণ ণ
হয়৷ যেমন: কণ্টক, লুণ্ঠন, প্রচণ্ড৷ কিন্তু তত্সম ছাড়া অন্যান্য সকল
শব্দের ক্ষেত্রে ট ঠ ড ঢ-য়ের আগেও কেবল ন হবে৷ যেমন: ঘন্টা, প্যান্ট,
প্রেসিডেন্ট, লন্ঠন, গুন্ডা, পান্ডা, ব্যান্ড, লন্ডভন্ড৷
শ, ষ, স
- তৎসম শব্দে শ, ষ, স-য়ের নিয়ম মানতে হবে৷
এ-ছাড়া
অন্য কোনো ক্ষেত্রে সংস্কৃতের ষত্ব-বিধি প্রযোজ্য হবে না৷
- বিদেশী মূল শব্দে শ, স-য়ের যে প্রতিষঙ্গী বর্ণ
বা
ধ্বনি রয়েছে বাংলা বানানে তাই ব্যবহার করতে হবে৷ যেমন: সাল (=বত্সর), সন,
হিসাব, শহর, শরবত, শামিয়ানা, শখ, শৌখিন, মসলা, জিনিস, আপস, সাদা, পোশাক,
বেহেশ্ ত, নাশতা, কিশমিশ, শরম, শয়তান, শার্ট, স্মার্ট৷ তবে, পুলিশ শব্দটি
ব্যতিক্রমরূপে শ দিয়ে লেখা হবে৷
- তৎসম শব্দে ট, ঠ বর্ণের পূর্বে ষ হয়৷ যেমন:
বৃষ্টি,
দুষ্ট, নিষ্ঠা, পৃষ্ঠা৷ কিন্তু বিদেশী শব্দে এই ক্ষেত্রে স হবে৷ যেমন:
স্টল, স্টাইল, স্টিমার, স্টুডিয়ো, স্টেশন, স্টোর, স্ট্রিট৷ কিন্তু
খ্রিষ্ট যেহেতু বাংলায় আত্তীকৃত শব্দ এবং এর উচ্চারণও হয় তত্সম কৃষ্টি,
তুষ্ট, ইত্যাদি শব্দের মতো, তাই ষ্ট দিয়ে খ্রিষ্ট শব্দটি লেখা হবে৷
আরবি-ফারসি থেকে আগত স/শ
আরবি-ফারসি শব্দে 'সে' , 'সিন্', 'সোয়াদ' বর্ণগুলির প্রতিবর্ণরূপে স, এবং
'শিন্' -এর প্রতিবর্ণরূপে শ ব্যবহৃত হবে৷ যেমন: সালাম, তসলিম, ইসলাম,
মুসলিম, মুসলমান, সালাত, এশা, শাবান (হিজরি মাস), শাওয়াল (হিজরি মাস),
বেহেশ্ত৷ এই ক্ষেত্রে স-এর পরিবর্তে ছ লেখার কিছু কিছু প্রবণতা দেখা
যায়, তা ঠিক নয়৷ তবে যেখানে বাংলায় বিদেশী শব্দের বানান সম্পূর্ণ
পরিবর্তিত হয়ে স ছ-য়ের রূপ লাভ করেছে সেখানে ছ ব্যবহার করতে হবে৷ যেমন:
পছন্দ, মিছিল, মিছরি, তছনছ৷
ইংরেজি থেকে আগত s
ইংরেজি ও ইংরেজির মাধ্যমে আগত বিদেশী s বর্ণ বা ধ্বনির জন্য স এবং sh,
-sion, -ssion, -tion প্রভৃতি বর্ণগুচ্ছ বা ধ্বনির জন্য শ ব্যবহৃত হবে৷
জ, য
বাংলায় প্রচলিত বিদেশী শব্দ সাধারণভাবে বাংলা ভাষার ধ্বনিপদ্ধতি অনুযায়ী
লিখতে হবে৷ যেমন: কাগজ, জাহাজ, হুকুম, হাসপাতাল, টেবিল, পুলিশ, ফিরিস্তি,
হাজার, বাজার, জুলুম, জেব্রা৷
কিন্তু ইসলাম ধর্ম-সংক্রান্ত কয়েকটি বিশেষ শব্দে 'যে', 'যাল', 'যোয়াদ',
'যোয়া' রয়েছে, যার ধ্বনি ইংরেজি z-এর মতো৷ সেক্ষেত্রে উক্ত আরবি
বর্ণগুলির জন্য য ব্যবহার হওয়া সঙ্গত৷ যেমন: আযান, এযিন, ওযু, কাযা,
নামায, মুয়ায্ যিন, যোহর, রমযান৷ তবে কেউ ইচ্ছা করলে এই ক্ষেত্রে য-এর
পরিবর্তে জ ব্যবহার করতে পারেন৷ জাদু, জোয়াল, জো, ইত্যাদি শব্দ জ দিয়ে
লেখা বাঞ্ছনীয়৷
এ, অ্যা
- বাংলায় এ বা ে-কার দ্বারা অবিকৃত এ এবং বিকৃত
বা
ব্যাঁকা অ্যা এই উভয় উচ্চারণ বা ধ্বনি নিষ্পন্ন হয়৷ তত্সম বা সংস্কৃত
ব্যাস, ব্যায়াম, ব্যাহত, ব্যাপ্ত, জ্যামিতি, ইত্যাদি শব্দের বানান
অনুরূপভাবে লেখার নিয়ম আছে৷
- অনুরূপ তৎসম এবং বিদেশী শব্দ ছাড়া অন্য সকল
বানানে
অবিকৃত-বিকৃত নির্বিশেষে এ বা ে-কার হবে৷ যেমন: দেখে, দেখি, জেনো, কেন,
কেনো (ক্রয় করো), গেল, গেলে, গেছে৷
- বিদেশী শব্দে অবিকৃত উচ্চারণের ক্ষেত্রে এ বা
ে-কার
ব্যবহৃত হবে৷ যেমন: এন্ড (end) , নেট, বেড, শেড৷
- বিদেশী শব্দে বিকৃত বা ব্যাঁকা উচ্চারণে অ্যা বা
(য-ফলা+আ-কার) ব্যবহৃত হবে৷ যেমন: অ্যান্ড (and), অ্যাবসার্ড, অ্যাসিড,
ক্যাসেট, ব্যাক, ম্যানেজার, হ্যাট৷
- তবে কিছু তদ্ভব এবং বিশেষ কিছু দেশী শব্দ রয়েছে
যার
(য-ফলা+আ-কার)-যুক্ত রূপ বহুল-পরিচিত৷ যেমন: ব্যাঙ, চ্যাঙ, ল্যাঙ, ল্যাঠা৷
এ-সব শব্দে (য-ফলা+আ-কার) অপরিবর্তিত থাকবে৷
ও এবং োকার
বাংলা অ-কারের উচ্চারণ বহুক্ষেত্রে ও-কার হয়৷ এই উচ্চারণকে লিখিত রূপ
দেওয়ার জন্য ক্রিয়াপদের বেশ কয়েকটি রূপের এবং কিছু বিশেষণ ও অব্যয়
পদের শেষে, কখনো আদিতে অনেকে যথেচ্ছভাবে ো-কার ব্যবহার করছেন৷ যেমন: ছিলো,
করলো, বলতো, কোরছ, হোলে, যেনো, কেনো (কীজন্য), ইত্যাদি ো-কারযুক্ত বানান
লেখা হচ্ছে৷ বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া অনুরূপ ো-কার ব্যবহার করা হবে না৷
বিশেষ ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে এমন অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়াপদ এবং বিশেষণ ও
অব্যয় পদ বা অন্য শব্দ যার শেষে ো-কার যুক্ত না করলে অর্থ অনুধাবনে
ভ্রান্তি বা বিলম্ব ঘটতে পারে৷
ক্রিয়াপদের যা যা রূপে ো-কার লাগানো হবে:
- তুমি, তোমরা (সাধারণ বর্তমান কাল): ধরো, চড়ো,
বলো, হও,
খাও, যাও, বানাও
- তুমি, তোমরা (ঘটমান বর্তমান কাল): ধরছো, চড়ছো,
বলছো,
হচ্ছো, খাচ্ছো, যাচ্ছো, বানাচ্ছো
- তুমি, তোমরা (পুরাঘটিত বর্তমান কাল): ধরেছো,
চড়েছো,
বলেছো, হয়েছো, খেয়েছো, গেছো, বানিয়েছো
- তুমি, তোমরা (বর্তমান অনুজ্ঞা): ধরো, চড়ো, বলো,
হও,
খাও, যাও, বানাও
- তুমি, তোমরা (ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা): ধোরো, চোড়ো,
বোলো,
হয়ো, খেও, যেও, বানিও
- সাধিত ধাতুর অসমাপিকা রূপ: ধরানো, চড়ানো, বলানো,
খাওয়ানো, বানানো
ক্রিয়াপদের যা যা রূপে ো-কার লাগানো হবে না:
- এ, এরা, ও, ওরা, সে, তারা (সাধারণ অতীত কাল):
ধরল,
চড়ল, বলল, হল, খেল, গেল, বানাল
- এ, এরা, ও, ওরা, সে, তারা (ঘটমান অতীত কাল):
ধরছিল,
চড়ছিল, বলছিল, হচ্ছিল, যাচ্ছিল, বানাচ্ছিল
- এ, এরা, ও, ওরা, সে, তারা (পুরাঘটিত অতীত কাল):
ধরেছিল,
চড়েছিল, বলেছিল, হয়েছিল, গেছিল/গিয়েছিল, বানিয়েছিল
- এ, এরা, ও, ওরা, সে, তারা (নিত্যবৃত্ত অতীত কাল):
ধরত,
চড়ত, বলত, হত, খেত, যেত, বানাত
- আমি, আমরা (সাধারণ ভবিষ্যৎ কাল): ধরব, চড়ব, বলব,
হব,
খাব, যাব, বানাব
- পুরাঘটিত অসমাপিকা রূপ: ধরে (ধোরে বা ধ'রে নয়),
চড়ে,
বলে, হয়ে
অন্যান্য শব্দ:
- ো-কারযুক্ত: তো, মতো, ভালো, আলো, কালো, কেন
(কিসের
জন্য), যেন, কোনো (বা কোনও), এখনো (বা এখনও), তখনো (বা তখনও), কারো (বা
কারও)
- ো-কারবিহীন: বড় (বড়ো নয়), ঘন (ঘনো নয়), মন
(মোন
নয়), একজন (একজোন নয়), এক শ (অর্থাৎ ১০০; এক শো বা এক শ' নয়)
ং, ঙ
তৎসম শব্দে ং এবং ঙ যেখানে যেভাবে ব্যবহার্য ও ব্যাকরণসম্মত সেইভাবে
ব্যবহার করতে হবে৷ এ-সম্পর্কে পূর্বে উইকিপিডিয়া:বাংলা বানানের
নিয়ম#তৎসম শব্দ অনুচ্ছেদে কিছু নিয়মের কথা বলা হয়েছে৷ তদ্ভব, দেশী,
বিদেশী, মিশ্র শব্দের বানানের ক্ষেত্রে ওই নিয়মের বাধ্যবাধকতা নেই৷ তবে
এই ক্ষেত্রে প্রত্যয় ও বিভক্তিহীন শব্দের শেষে সাধারণভাবে অনুস্বার (ং)
ব্যবহৃত হবে৷ যেমন: রং, সং, পালং, ঢং, রাং, গাং৷ তবে শব্দে অব্যয় বা
বিভক্তি যুক্ত হলে কিংবা পদের মধ্যে বা শেষে স্বরচিহ্ন থাকলে ঙ হবে৷ যেমন:
বাঙালি, ভাঙা, রঙিন, রঙের৷ বাংলা ও বাংলাদেশ শব্দ-দু'টি ং দিয়ে লিখতে
হবে৷ বাংলাদেশের সংবিধানে তাই করা হয়েছে৷
রেফ ও দ্বিত্ব
তৎসম শব্দের অনুরূপ বানানের ক্ষেত্রে যেমন পূর্বে বলা হয়েছে, অ-তৎসম সকল
শব্দেও রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না৷ যেমন: কর্জ, কোর্তা, মর্দ,
সর্দার৷
বিসর্গ
শব্দের শেষে বিসর্গ (ঃ) থাকবে না৷ যেমন: কার্যত, মূলত, প্রধানত, প্রয়াত,
বস্তুত, ক্রমশ, প্রায়শ৷
পদমধ্যস্থ বিসর্গ থাকবে৷ তবে অভিধানসিদ্ধ হলে পদমধ্যস্থ বিসর্গ বর্জনীয়৷
যেমন: দুস্থ, নিস্পৃহ৷
বিদেশী শব্দ ও যুক্তবর্ণ
বাংলায় বিদেশী শব্দের বানানে যুক্তবর্ণকে বিশ্লিষ্ট করার প্রবণতা দেখা
যাচ্ছে৷ যুক্তবর্ণের সুবিধা হচ্ছে তা উচ্চারণের দ্বিধা দূর করে৷ তাই
ব্যাপকভাবে বিদেশী শব্দের বানানে যুক্তবর্ণ বিশ্লিষ্ট করা অর্থাত্ ভেঙে
দেওয়া উচিত নয়৷ শব্দের আদিতে তো অনুরূপ বিশ্লেষ সম্ভবই নয়৷ যেমন:
স্টেশন, স্ট্রিট, স্প্রিং৷
হস্-চিহ্ন
- হস্-চিহ্ন যথাসম্ভব বর্জন করা হবে৷ যেমন: কাত,
মদ, চট,
ফটফট, কলকল, ঝরঝর, তছনছ, জজ, টন, হুক, চেক, ডিশ, করলেন, বললেন, শখ, টাক,
টক, করিস, দিস, দেখলে৷
- তবে যদি ভুল উচ্চারনের আশঙ্কা থাকে তাহলে
হস্-চিহ্ন
ব্যবহার করা যেতে পারে৷ যেমন: উহ্, যাহ্, ওয়াক্ফ৷
- যদি অর্থের বিভ্রান্তির আশঙ্কা থাকে তাহলেও তুচ্ছ
অনুজ্ঞায় হস্-চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে৷ যেমন: কর্, ধর্, মর্, বল্।
ঊর্ধ্ব-কমা
ঊর্ধ্ব-কমা যথাসম্ভব বর্জন করা হবে৷ যেমন: করল
(<কর'ল<করিল), ধরত (<ধর'ত<ধরিত), বলে
(<ব'লে<বলিয়া), হয়ে (হ'য়ে<হইয়া), দু জন
(<দু' জন), চার শ (<চার শ'), চাল
(<চা'ল<চাউল), আল (<আ'ল<আইল)৷
বিবিধ
সমাসবদ্ধ
পদ
- সমাসবদ্ধ পদগুলি একসঙ্গে লিখতে হবে, মাঝখানে ফাঁক
রাখা
চলবে না৷ যেমন: সংবাদপত্র, অনাস্বাদিতপূর্ব, পূর্বপরিচিত, রবিবার,
মঙ্গলবার, স্বভাবগতভাবে, লক্ষ্যভ্রষ্ট, বারবার, বিষাদমন্ডিত, সমস্যাপূর্ণ,
অদৃষ্টপূর্ব, দৃঢ়সঙ্কল্প, সংযতবাক, নেশাগ্রস্ত, পিতাপুত্র৷
- তবে বহুল প্রচলিত বলে কিছু শব্দে ঈ-কার বজায়
থাকবে।
যেমন: গাভী, পল্লী, রানী, শ্রেণী।
- বিশেষ প্রয়োজনে সমাসবদ্ধ পদটিকে একটি, কখনো
একটির বেশি
হাইফেন (-) দিয়ে যুক্ত করা যায়৷ যেমন- মা-মেয়ে, মা-ছেলে, বেটা-বেটি,
বাপ-বেটা, ভবিষ্যত-তহবিল, সর্ব-অঙ্গ, বে-সামরিক, স্থল-জল-আকাশ-যুদ্ধ,
কিছু-না-কিছু৷
নঞর্থক শব্দ
নঞর্থক শব্দ আলাদা করে লেখা হবে, যেমন: জানি না ("জানিনা" নয়), হত না
("হতনা" নয়), শুনি নি ("শুনিনি" নয়), খাব না ("খাবনা" নয়), পান নি
("পাননি" নয়)।
|
১.সমাসবদ্ধ পদ সমাসবদ্ধ পদের মধ্যে ফাঁক হবে না। যেমন: বুদ্ধিজীবী, মরণশীল, হাতিঘোড়া। অর্থ ¯পষ্ট করার অথবা দীর্ঘ শব্দের দৃষ্টিকটুতা হ্রাসের প্রয়োজনে পদের মাঝখানে হাইফেন (-) দেয়া যায়; তবে ফাঁক রাখা অশুদ্ধ। যেমন: মরণশীল-কে মরণ শীল করা কী শুদ্ধ হবে? অবশ্যই না। আম-জাম-লিচু-কলা প্রভৃতি ছিল ঝুড়িতে। ২. ক্রিয়া পদের পূর্বে ব্যবহৃত হলে ‘না’ অব্যয়ের পর হাইফেন বসবে। যেমন: না-দেখা, না-খাওয়া, না-যাওয়া। তবে ক্রিয়া ব্যতিরেকে অন্য কোন শব্দের আদিতে ব্যবহৃত ‘না’ অব্যয়ের পর হাইফেন দেওয়া বিধেয় নয়। যেমন: নাবালক, নাহক, নাজায়েজ, নাপাক। ৩. কোন পদের পূর্বে বিশেষণ বসানো প্রয়োজন হলে কাঙ্খিত বিশেষণটি পরবর্তী পদের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে পৃথক বসে। যেমন নীল আকাশ, জ্যোৎস্না রাত, লাল শাড়ি, পাকা বাড়ি। তবে বিশেষ্যের সঙ্গে যে বিশেষণ বসানো হয় তার কোন বিশেষণ থাকলে পদদ্বয় একত্রে বসে। যেমন: বিশ্বসুন্দরী, রক্তলাল ইত্যাদি। ৪.‘মহা’ শব্দটি ভাল, উত্তম কিংবা মহান অর্থে ব্যবহৃত হলে সংশ্লিষ্ট পদের সঙ্গে একত্রে বসে। যেমন- মহানবী, মহাপুরুষ, মহাজ্ঞানী। তবে, ‘মহা’ শব্দটি বিরাট কিংবা প্রচ- অর্থে ব্যবহৃত হলে পৃথক বসে। যেমন: মহা পাপী, মহা বোকা, মহা লুচ্চা, মহা ঝিল ইত্যাদি। ৪. ‘আগামী’ ও ‘গত’ শব্দ দুটির পরবর্তী শব্দ পৃথক বসবে। যেমন- আগামী কাল, আগামী বছর, গত দিন, গত মাস, গত কাল, গত বার, আগামী মৌসুম, আগামী সন, গত বছর ইত্যাদি। ৫. সংখ্যাবাচক শব্দ একত্রে লেখা যায়। যেমন: দুজন, পাঁচহাজার টাকা, নয়গাড়ি ইত্যাদি। ৬ . ‘কাল’ এবং ‘ক্ষণ’ শব্দের পূর্ববর্তী বিশেষণ পৃথক বসে না, একত্রে বসে। যথা: (একাল, এক্ষণ), (এতকাল, এতক্ষণ), (কতকাল, কতক্ষণ), (ততকাল, যতক্ষণ), (বহুকাল, বহুক্ষণ), (কিছুকাল, কিছুক্ষণ) ইত্যাদি। ৭. ‘এত, তত, অনেক, কয়েক, যত, বহু, কত, কিছ’ু ইত্যাদির পরে ‘কাল এবং ক্ষণ’ ছাড়া অন্য শব্দ যুক্ত হলে তা পৃথক বসবে। উদাহরণ: এত দিন, কত দিন, তত দিন, কত বছর, বহু দিন, অনেক সময়, এত লোক, কত টাকা, কিছু দিন। ৮. ‘না নাই নেই ’ ইত্যাদি ‘নঞর্থক অব্যয়’ শব্দ বা পদের শেষে সেঁটে বসে না, পৃথক বসে। যথা- খাব না, পাব না, যাব না, দেখি নাই, মনে নেই, পান না, খায় না, যায় নাই ইত্যাদি। তবে ‘নঞর্থক’ শব্দ ‘না’ পদের সাথে সেঁটে বসবে। যেমন: পাননি, খাননি, দেননি ইত্যাদি। ৯. ‘এক’ শব্দটি সংখ্যা না বুঝিয়ে সংযোজন বা সম্মিলন অর্থ বুঝালে ‘এক’ শব্দের পরবর্তী শব্দটি সংশ্লিষ্ট শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসে। যথা: একসঙ্গে, একযাত্রা, একমাত্র, একবার ইত্যাদি। ১০. ‘নানা’ কিংবা ‘নানান’ শব্দটি সাধারণত পৃথক বসে। যেমন- নানান রকম মানুষ, নানা রকম কথা, নানান ফল, নানান দেশ ইত্যাদি। ১১. ‘পর’ শব্দ দূরবর্তী, পরবর্তী, অন্য কিংবা ভিন্ন অর্থ জ্ঞাপন করলে ‘পর’ শব্দটি পরবর্তী শব্দের সাথে সেঁটে বসবে। যেমন- পরজীবী, পরনারী, পরধর্ম, পরকাল, পরলোক, পরবাসী। ‘মাত্র’ শব্দের অর্থ প্রত্যেক, পর্যন্ত বা তখনই বোঝালে ‘মাত্র’ শব্দটি পূর্ববর্তী শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসে। যেমন: বলামাত্র, দেখামাত্র, শুনামাত্র। ১২. ‘প্রতি’ শব্দটি ‘ব্যাপ্তি’ অর্থে ব্যবহৃত হলে তা পূর্বের বা পরবর্তী শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসে, ফাঁক রাখে না। যেমন: প্রতিশব্দ, প্রতিবছর, প্রতিক্ষণ, জনপ্রতি। ১৩. ব্যাপী, সমেত, সহ, ভাবে, বহুল প্রভৃতি শব্দ পূর্ববর্তী শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসে। যেমন- দেশব্যাপী, প্রত্যক্ষভাবে, জনবহুল, মালসমেত, বহুলপ্রচলিত, জরুরিভাবে, আম, জাম, কলা ও লিচুসহ ইত্যাদি। ১৪. বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত শব্দ ‘বহু’ ‘গত’ ও ‘পূর্ব’ শব্দগুলো স¤পর্কযুক্ত শব্দের পূর্বে একত্রে বসে। উদাহরণ: বহুকাল, বহুদিন, বহুমূল্য, বহুমুখী, বহুজন, গতযৌবন, গতজীবন, পূর্বশর্ত, পূর্বমুখী, অদৃষ্টপূর্ব। ব্যতিক্রম: বহু কষ্ট, বহু যন্ত্রণা, বহু লোক। ১৫. ব্যতীত এবং ব্যতিরেকে ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে ‘বিনা’ শব্দটি পৃথক বসে। উদাহরণ: বিনা বাক্যে, বিনা যুদ্ধে, বিনা মূল্যে, বিনা পরিশ্রমে। ১৬.‘বিশেষ’ ও ‘বহুল’ শব্দদ্বয় স¤পর্কযুক্ত শব্দের পরে বসলে একত্রে সেঁটে বসে। যেমন: অবস্থাবিশেষ, দর্শনবিশেষ, পু¯পবিশেষ, ইতরবিশেষ, ঘটনাবহুল, ব্যয়বহুল, কষ্টবহুল ইত্যাদি। কিন্তু ‘বিশেষ’ ও ‘বহুল’ শব্দদ্বয় স¤পর্কযুক্ত শব্দের পূর্বে বসলে পরস্পরের মধ্যে ফাঁক রেখে বসে। যেমন: বিশেষ সভা, বিশেষ আলাপ, বিশেষ বিবেচনা, বহুল প্রচলিত, বহুল প্রয়োগ, বহুল প্রচার, বহুল আলোচিত ইত্যাদি। ‘মাত্র’ শব্দটি স¤পর্কযুক্ত শব্দের পূর্বে বসলে পৃথক এবং পরে বসলে একত্রে বসবে। উদাহারণ- মাত্র বিশ মিনিট, মাত্র একটা ভুল, দেখামাত্র, কিছুমাত্র, তিলমাত্র, বলামাত্র, দেখামাত্রা, একমাত্র, কেবলমাত্র, প্রাণীমাত্র। ১৭.এছাড়া, তাছাড়া, যেভাবে, সেভাবে, যেক্ষেত্রে, সেক্ষেত্রে, একাল, সেকাল, এরকম, সেরকম ইত্যাদি একসঙ্গে লেখা হবে।
|
Ref:
Wikipedia
|
|
|