অনেক রক্ত ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা। দীর্ঘকালব্যাপী দেশি-বিদেশি শাসক-শোষকদের শোষণ, জুলুম, নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিবাদ-আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা ধাপে ধাপে বেগবান হয়ে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষণা ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনার মধ্য দিয়ে পূর্ণতা লাভ করেছিল। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে বিদ্রোহ, বিক্ষোভ, সশস্ত্র সংগ্রামের একটা ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এসব বিদ্রোহের স্বরূপ ছিল বিভিন্নমূখী। আঞ্চলিকতা, ধর্মগত বিরোধ, উৎপীড়ন-নিপীড়ন, শোষণ-বঞ্চনা, স্বাধীনতা, ন্যায্য অধিকার ইত্যাদি ছিল এসব বিদ্রোহের কারণ।
বাঙালি জাতির নেতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে হীনমন্যতা। তাই ইতিহাসে দেখা যায় কোনো হিন্দু বাঙালি অর্থ-শিক্ষা-যশ ইত্যাদি অর্জিত হলে নিজেকে বাঙালির পরিবর্তে আর্য জাতির উত্তর পুরুষ কিংবা উচ্চ বর্ণের হিন্দু সন্তান হিসাবে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন, একই অবস্থায় মুসলমান বাঙালি হলে নিজের পূর্ব পুরুষ আরব থেকে এসেছিলেন বলে অহংকার করতেন। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে উচ্চ-নিম্ন সকল হিন্দু-মুসলমান বাঙালি ইতিহাসে প্রথম বারের মত দীর্ঘদিনের হীনমন্যতা ভুলে একই পতাকা তলে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তুলেছিলেন: ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’; ‘জেগেছে জেগেছে, বাঙালিরা জেগেছে’; ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি হতে যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল সেগুলোর কালানুক্রমিক তালিকা, একাত্তরের অগ্নিগর্ভা মার্চের ঘটনাসমূহ এবং ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে এখানে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো।
বাংলায় বৃটিশ শাসনের গ্লানি
১৭৬৭ সালে সিলেট-ত্রিপুরা জেলার রোশনাবাদ পরগনায় কৃষক বিদ্রোহ ও তাদের উদ্যেগে নিঃস্ব প্রজাদের সমবায় রাজ্য প্রতিষ্ঠা।
১৮৩১ সালে বাংলার প্রজাকুলের উপর স্থানীয় জমিদার এবং ইউরোপীয় নীলকরদের অত্যাচার প্রতিরোধ এবং ব্রিটিশ শাসন থেকে বাংলাকে মুক্ত করার লক্ষ্যে তিতুমীরের নেতৃত্বে বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে পরিচালিত আন্দোলন।
১৮৫৭ সালে বৃটিশ-বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসাবে ভারতের সিপাহীরা যে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে (সিপাহী বিদ্রোহ), তাতে বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষও জড়িয়ে পড়েছিল।
১৯৩০ সালে বিপ্লবী নেতা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠিত হয়। তাঁরা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা করারও পরিকল্পনা করেছিলেন।
১৮৫৯-১৮৬১ সালে বাংলায় নীল ব্যবসায়ী ও নীলকরদের বিরুদ্ধে শোষিত নীল চাষীদের প্রতিরোধ আন্দোলন।
১৯০৫ সালে বিদেশী পণ্য বজর্ণের সূচনা এবং ১৯০৬ সালে স্বদেশী পণ্য উৎপাদনের চেষ্টায় বঙ্গলক্ষ্নী কটন মিলস্ প্রতিষ্ঠা।
পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে ঘটনা প্রবাহ
১৯০৫ সালে বঙ্গদেশকে দু’টি নতুন প্রদেশে বিভক্ত করা হয়, পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ। ঢাকায় স্থাপিত হয় পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী। এতে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা অত্যধিক খুশি হন এবং বঙ্গীয় কংগ্রেস জাতীয়তাবাদী বিশেষ করে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা এতে চরম হতাশা ব্যক্ত করে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করে।
১৯০৬ সালে ঢাকায় সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করা হয় যার উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষা করা।
১৯০৬ সালে সিমলা প্রতিনিধিদল লর্ড মিন্টোর কাছে মুসলিম সম্প্রদায়ের তুলনামূলক পশ্চাৎপদতা ব্যাখ্যা করেন এবং ভবিষ্যৎ সরকার গঠনে প্রাপ্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি জানান।
১৯০৯ সালে মর্লি-মিন্টো সংস্কারের মধ্য দিয়ে হিন্দু মুসলমানের পৃথক নির্বাচনের সূচনা হয় এবং মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতির ভিত্তি রচিত হয়।
১৯১২ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়। পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা এ পদক্ষেপে চরমভাবে হতাশ হয়। মুসলিম স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে জনমত গঠনের জন্য বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ গঠন করা হয়।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলার উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ে বিশেষ করে মুসলমান ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি।
১৯২৩ সালে বঙ্গীয় হিন্দু-মুসলমান নেতৃবর্গের মধ্যে সম্পাদিত বেঙ্গল প্যাক্ট নামীয় চুক্তির শর্ত মোতাবেক বঙ্গীয় মুসলমানদের আপেক্ষিক পশ্চাদপদতা দূর করার লক্ষ্যে তাদের জন্য অধিক সংখ্যক সরকারি চাকরি বরাদ্ধ রাখার অঙ্গীকার করা হয়।
১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইনে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয় এবং এভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার মুসলমানদের নিজস্ব সরকার গঠনের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। কংগ্রেস সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের অজুহাত দেখিয়ে এ আইনের বিরোধীতা করার ফলে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের আরো অবনতি হয়।
১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে আসন জয়ের ব্যাপারে বাংলায় কংগ্রেসের স্থান ছিল প্রথম, দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে মুসলিম লীগ এবং কৃষক প্রজা পার্টি পায় তৃতীয় স্থান। পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতিবাদে কংগ্রেস সরকার গঠন করতে অস্বীকৃতি জানায়। তবে কৃষক প্রজা পার্টি নেতা এ.কে ফজলুল হক মুসলিম লীগ এবং কিছু দলছুট সদস্যের সমন্বয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করতে সক্ষম হন।
১৯৩৮-৩৯ সালে কংগ্রেসের অসহযোগিতার কারণে এ.কে ফজলুল হক নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জমিদারী প্রথা বিলোপ করতে ব্যর্থ হন। এতে মুসলমান কৃষক সমাজ কংগ্রেসের সদিচ্ছা সম্পর্কে সন্দিগ্ধ হয়ে উঠে।
১৯৪০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সাধারণ সভায় গৃহীত প্রস্তাবে দ্বিজাতিতত্ত্ব ঘোষণা করা হয় এবং ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলিকে নিয়ে একটি ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ ঘোষণার জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়।
১৯৪২ সালে গান্ধীজীর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু।
১৯৪৩ সালে খাজা নাজিমউদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রী করে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে।
১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ পাকিস্তানের ধারণাকে প্রধান ইস্যু হিসেবে তুলে ধরে। আইন পরিষদে মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়ে বাংলায় মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জয় ঘোষণা করে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুসলিম লীগের মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টকে মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘোষণা করে সোহরাওয়ার্দী হরতাল ডেকে দিবসটিকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেন। উপমহাদেশের সর্বত্র মুসলমানগণ ওই দিন সকল কাজ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে, হিন্দু জনমত পাকিস্তান-বিরোধী শ্লোগানকে কেন্দ্র করে সুসংগঠিত হতে থাকে। ফলে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। সরকারি হিসাব মতে কলকাতায় এ দাঙ্গায় ৪,০০০ লোক নিহত ও ১,০০,০০০ আহত হয়। হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের হাজার হাজার লোকের মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব বরণের মধ্য দিয়ে হরতালের পরিসমাপ্তি ঘটে। একই ধারাবাহিকতায় হিন্দু মহাসভা সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বঙ্গভঙ্গ দাবি করে। অচিরেই কংগ্রেস দল এই দাবি সমর্থন করে।
১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনাধীনে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বাংলা ভাগ করে পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
১৯৪৬-৪৭ সালে কৃষি উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশের দাবিতে সংগঠিত বর্গাচাষিদের তেভাগা আন্দোলন চলে। মূলত তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত করেন বাংলার প্রাদেশিক কৃষকসভার কম্যুনিস্ট কর্মীরা।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গদেশকে পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গ এই দুইভাগে বিভক্ত করা হয়। পূর্ববঙ্গ ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম ধারণ করে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে পরিণত হয়।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় যাত্রা
১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্ববঙ্গ সফর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ঘোষণা দেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। উপস্থিত ছাত্ররা তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রস্তাবের প্রতিবাদ করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়।
১৯৪৯ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ দ্বিখন্ডিত হয়ে মুসলিম লীগের উদারপন্থী ও বামপন্থীরা আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে এর সভাপতি নির্বাচিত করে।
১৯৪৯ সালের ১৮ আগষ্ট বিয়ানীবাজার উপজেলার সানেশ্বর উলুউরি গ্রামের সুনাই নদীর তীরে ঘৃন্য নানকার প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী (নানকার বিদ্রোহ) নানকারদের উপর পাকিস্থানী মুসলিমলীগ সরকারের ইপিআর, পুলিশ এবং জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনী সঙ্গবদ্ধ হয়ে সশ্রস্ত্র হামলা চালালে ৬ জন নানকার নিহত হন।
১৯৫২সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, শহীদ দিবস। বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলে ধরতে গিয়ে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় এক প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয় এবং ফৌজদারী কার্যবিধির ১৪৪ ধারা অমান্য করে শোভাযাত্রা বের করে। পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এতে কয়েকজন ছাত্র নিহত হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গণআন্দোলনের সূত্রপাত হয়।
১৯৫৩ সালে এ.কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির পুনরুজ্জীবিত রূপ কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি) তার একুশ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। লাহোর প্রস্তাবের মর্মবাণী অনুযায়ী পূর্ব-পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্জন করা ছিল এ কর্মসূচির মূল দাবি।
১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসে মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট নামে একটি নির্বাচনী জোট গঠন করা হয়। আওয়ামী লীগ, কেএসপি, নেজামে ইসলাম এবং গণতন্ত্রী দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। এই নির্বাচনী জোট পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা, আঞ্চলিক বৈষম্যের অবসান এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের ওপর মূল দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ২১-দফার একটি নির্বাচনী মেনিফেস্টো প্রকাশ করে।
১৯৫৪ সালের ১১ মার্চ পূর্ববঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে জয়লাভ করে। কৃষক শ্রমিক পার্টি প্রধান এ.কে ফজলুল হক পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাঙালির এই আধিপত্য মেনে নিতে পারেনি।
১৯৫৪ সালের ৩১ মে মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানকে বরখাস্ত করে গৃহবন্দী রাখা হয়। অভিযোগ, তাঁরা পূর্ববঙ্গকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
১৯৫৪ সালের ১৯ অক্টোবর বগুড়ার জয়পুরহাটে আওয়ামী লীগের কনভেনশনে দলের নাম আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে ’আওয়ামী লীগ’ করা হয়। এ পরিবর্তন দলটির পাকিস্তানি মুসলিম জাতীয়তাবাদী নীতি পরিত্যাগ করে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী নীতি অনুসরণের ইঙ্গিত বহন করে।
১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল প্রাদেশিক পরিষদে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়।
১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মীর্যাকে উৎখাত করে সামরিক আইন জারী করেন। সামরিক আইনে সকল নির্বাচনী ব্যবস্থা বিলুপ্ত ও রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয় এবং প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের নির্বাচনে প্রতিযোগিতার অযোগ্য ঘোষণা করে একাধিক সামরিক বিধিনিষেধ জারি করা হয়।
১৯৬২ সালের জানুয়ারি মাসে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ এবং জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ১৯৬২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক নেতা-কর্মীকে বন্দী করা হয়। ২২ সেপ্টেম্বর পুলিশ প্রতিবাদ দিবস পালনরত ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করে।
১৯৬৩-১৯৬৫ বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও অর্থনীতিবিদগণ পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য তুলে ধরেন। তারা তথ্যভিত্তিক যুক্তি দেন, কিভাবে পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থে ব্যবহূত হচ্ছে, এবং স্বায়ত্তশাসন পেলে কিভাবে পূর্ব পাকিস্তান স্বয়ং সম্পূর্ণ ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারে।
১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধী দলের নেতৃবর্গ লাহোরে একটি জাতীয় কনভেনশন আহবান করেন। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান দলের অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের নিয়ে ওই কনভেনশনে যোগদান করেন এবং এ সম্মেলনের সমর্থন আদায়ের জন্য তাঁর যুগান্তকারী ৬-দফা দাবি উপস্থাপন করেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো ৬-দফা ফর্মূলাকে একটি উদ্ভট প্রস্তাব বলে প্রত্যাখ্যান করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় ৬-দফা কর্মসূচি নিয়ে বৈরী লেখালেখি হয় এবং শেখ মুজিবকে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে তুলে ধরা হয়। শেখ মুজিব সম্মেলন বয়কট করে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন।
১৯৬৬ সালের ১৮ এপ্রিল, জরুরি বিধিবলে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। শেখ মুজিবের ৬-দফা সনদের সমর্থনে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারের বিরুদ্ধে জন-প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে।
১৯৬৭ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, শেখ মুজিবুর রহমান এবং আরো চৌত্রিশ জন জননেতা, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, ব্যবসায়ী এবং আমলাকে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তানকে স্বাধীন করার কথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলায় জড়ানো হয়।
১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শুরু হয়। বামপন্থী রাজনীতিবিদ এবং ছাত্ররা স্বাধীন পূর্ববাংলা প্রজাতন্ত্রের নাম দিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করে। তাদের শ্লোগান ছিল, ‘স্বাধীন পূর্ববাংলা প্রজাতন্ত্র কায়েম কর’।
১৯৬৯-এর গণআন্দোলন – ১১ দফা ও ৬ দফা ফর্মূলা
১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গণআন্দোলন কার্যত একটি গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১-দফা সনদ ঘোষণা করে যার লক্ষ্য ছিল কার্যত পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা অর্জন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কতিপয় শ্লোগানের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণাকে সুস্পষ্ট করেছিল। যেমন, ‘জাগো, জাগো, বাঙালি জাগো, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’; ‘তোমার দেশ, আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। ছাত্ররা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীতও নির্বাচন করেন। তাঁদের জাগরণী শ্লোগান ছিল ‘জয়বাংলা’।
২২ ফেব্রুয়ারি দুর্বার গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে গণদাবির নিকট মাথা নত করে।
২৩ ফেব্রুয়ারি রমনা রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত সংবর্ধনা। শেখ মুজিবকে স্বাগত জানানোর জন্য সেখানে সমবেত জনতা জনসমুদ্রের রূপ নেয়। সভার সভাপতি ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্মানসূচক ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করার প্রস্তাব করলে হর্ষোৎফুলল জনতা বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় তা সমর্থন করে। পরবর্তী মিডিয়ার রিপোর্টেও জননেতাকে এই সম্মানসূচক খেতাবের জন্য অভিনন্দিত করা হয়। শেখ মুজিব দেশবাসী ও ‘বিপ্লবী জনতার’ প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে এই সম্মাননা গ্রহণ করেন।
১০ মার্চ সরকার আয়োজিত রাওয়ালপিন্ডি গোলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের ফেডারেল ব্যবস্থা ৬-দফা ফর্মূলা পেশ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা এ ৬-দফা ফর্মূলাকে পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য একটি ছদ্মকৌশল বলে আখ্যায়িত করেন।
২৫ মার্চ গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হওয়ায় এবং আইয়ূব বিরোধী আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলতে থাকায় ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খান পদত্যাগ করে জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। সামরিক আইন জারী করা হয়। জাতীয় এবং প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ইয়াহিয়া খান একটি সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করেন।
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন
১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর রেডিও পাকিস্তান বেতারযোগে নির্বাচনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু তাঁর ছয়দফা ভিত্তিক ফেডারেল ব্যবস্থার ধারণাটি নতুন করে উত্থাপন করেন এবং সবাইকে তাঁর ধারণাটি গ্রহণ করতে এবং ৬-দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্য নতুন একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নে তাঁকে সহযোগিতা করার আহবান জানান।
২৩ নভেম্বর পল্টন ময়দানের এক জনসভায় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঘোষণা করেন যে, অতীতের ঘটনাবলি এবং ১২ নভেম্বরের ঘূর্নিঝড় দুর্গত মানুষের প্রতি পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক উদাসীনতা থেকে তাঁর এই বিশ্বাস জন্মেছে যে, রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান অবাস্তব এবং লক্ষ্যহীন হয়ে পড়েছে। তিনি পূর্ব-পাকিস্তানের জনসাধারণকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার এবং এ ভূখন্ডকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করার দাবি জানান। তিনি ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ এই গতানুগতিক শ্লোগান না দিয়ে বক্তৃতা শেষ করেন ‘পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ শ্লোগান দিয়ে।
২৬ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকা সফর শেষে ঢাকায় ফিরে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ঘূর্নিঝড় দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পাকিস্তান সরকারের চরম ব্যর্থতা তুলে ধরেন এবং পরিশেষে ঘোষণা করেন যে, এটা যত না ক্ষমতাসীন সরকারের ব্যর্থতা তার চাইতে বড় ব্যর্থতা খোদ পাকিস্তান রাষ্ট্রের। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তব্য শেষ করেন এই বলে, পূর্ব-পাকিস্তানকে সম্ভব হলে ব্যালটের মাধ্যমে এবং প্রয়োজন হলে বুলেটের দ্বারা স্বায়ত্তশাসন অর্জন করতে হবে।
৪ ডিসেম্বর সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে আয়োজিত এক জনসভায় ছাত্রলীগ দুটি শ্লোগান তোলে: ক) কৃষক-শ্রমিক অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো, খ) গণবাহিনী গড়ে তোলো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। পল্টন ময়দানে ন্যাপ (ভাসানী), জাতীয় লীগ (আতাউর রহমান) এবং জামায়াত-ই-উলামায়ে ইসলাম (পীর মুহসিনউদ্দীন) আয়োজিত একটি যৌথ রাজনৈতিক জনসভায় মওলানা ভাসানী লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। এই জনসভায় বক্তৃতাকালে আতাউর রহমান খান এবং পীর মুহসিনউদ্দীনও মওলানা ভাসানীর এ প্রস্তাবের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন।
৭ এবং ১৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জনগণ ৬-দফা এবং ১১-দফা কর্মসুচির সমর্থনে ভোট দান করে। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে এবং জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়লাভ করে। তৎসত্ত্বেও আওয়ামী লীগ অথবা পাকিস্তান পিপলস পার্টি এদের কেউই নিজেদের প্রদেশের বাইরে একটি আসনেও জয়লাভ করতে পারে নি। এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তানের দুই প্রদেশ রাজনৈতিক দিক থেকে একে অপর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ৬-দফা এবং ১১-দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের শপথ গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে সকল নির্বাচিত প্রতিনিধি রমনায় মিলিত হন। বঙ্গবন্ধু এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। প্রতিনিধিরা তাদের উপর অর্পিত জনগণের আস্থা ৬-দফা এবং ১১-দফা প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকার এবং কখনও দোদুল্যমানতার পরিচয় না দেবার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন।
১২-১৩ জানুয়ারি জেনারেল ইয়াহিয়া ঢাকায় আসেন এবং শেখ মুজিব ও অন্যান্য নেতার সঙ্গে রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। শেখ মুজিব সাংবাদিকদের জানান যে, তাঁর এবং ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আন্তরিক ও সন্তোষজনক আলোচনা হয়েছে। ইয়াহিয়া খানও ঢাকা ত্যাগের সময় একই অভিমত ব্যক্ত করেন এবং শেখ মুজিবকে ‘পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী’ বলে সম্বোধন করেন।
২৭-২৮ জানুয়ারি ভূট্টো তাঁর প্রধান সহকর্মীদের নিয়ে ঢাকায় আসেন এবং ক্ষমতা ভাগবণ্টনের ব্যাপারে শেখ মুজিব এবং তাঁর অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করেন। এসব আলাপ আলোচনা থেকে ইতিবাচক কোনো ফল বেরিয়ে আসে নি। ভূট্টো সাংবাদিকদের কাছে এ মন্তব্য করে ঢাকা ত্যাগ করেন, ‘আরও আলাপ আলোচনার প্রয়োজন আছে।’ মুজিব সর্বশেষ ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ঢাকায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহবানের দাবি জানান।
২৭-২৮ জানুয়ারি ভূট্টো তাঁর প্রধান সহকর্মীদের নিয়ে ঢাকায় আসেন এবং ক্ষমতা ভাগবণ্টনের ব্যাপারে শেখ মুজিব এবং তাঁর অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করেন। এসব আলাপ আলোচনা থেকে ইতিবাচক কোনো ফল বেরিয়ে আসে নি। ভূট্টো সাংবাদিকদের কাছে এ মন্তব্য করে ঢাকা ত্যাগ করেন, ‘আরও আলাপ আলোচনার প্রয়োজন আছে।’ মুজিব সর্বশেষ ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ঢাকায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহবানের দাবি জানান।
১৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরুর ঘোষণা দেন। তিনি ঘোষণা দেন যে, ঢাকায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হবে ৩ মার্চ।
১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ঘোষণা দেন যে, ৬-দফা ইস্যুতে পূর্বাহ্নে একটি সমঝোতায় উপনীত না হওয়া পর্যন্ত তাঁর দল ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করবে না।
২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ মিনার থেকে ঘোষণা দেন যে, বাঙালির অধিকার ও স্বার্থের বিরুদ্ধে যেকোন চক্রান্তের মোকাবিলার জন্য জনগণকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
২২ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে মিলিটারি জেনারেলদের সাথে আলোচনায় বসেন এবং নিজের মতো করে সমস্যার সমাধান করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
২৪ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক দৃশ্যপটে নাটকীয় পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু একটি সাংবাদিক সম্মেলন ডাকেন। তিনি কুচক্রী সেনাবাহিনীর কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি জনগণকে স্মরণ করতে বলেন কিভাবে সেনাবাহিনী সেই ১৯৫৪ সাল থেকে এদেশের মাটিতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শেকড় গাড়তে বাধা প্রদান করেছে। তিনি ঘোষণা দেন যে, জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার রক্ষা এবং স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।
২৮ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় পরিষদের সদস্যদের ঢাকা অধিবেশনে যোগ দেয়ার এবং পাকিস্তানের জন্য একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সাহায্য করার আহবান জানান। একই দিন ভুট্টো হুমকি দেন যে, তিনি এবং তার দল ঢাকা অধিবেশন বর্জন করবে।
১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের নির্ধারিত অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করেন। তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকায় প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষ হোটেল পূর্বানীর সামনে জমায়েত হয়। সেখানে তখন বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল বৈঠক চলছিল। উত্তেজিত জনতা বঙ্গবন্ধুর কাছে অবিলম্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি জানান। বঙ্গবন্ধু জনতাকে সংযত থাকতে উপদেশ দেন এবং ৭ মার্চ পর্যন্ত প্রতিবাদ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেন যে, ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণী ঘোষণা দেবেন।
২ মার্চ শহরের সব এলাকা এবং শহরতলি থেকে ছাত্রজনতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় জমায়েত হতে থাকে। জনতা স্বাধীনতার শ্লোগান দিতে থাকে এবং ঐকতানে গাইতে থাকে স্বাধীনতার সঙ্গীত। ছাত্রনেতারা (নূরে আলম সিদ্দিকী, এএসএম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ এবং আবদুল কুদ্দুস মাখন) জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। তারপর ছাত্রলীগ নেতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসুর) সহ-সভাপতি এএসএম আবদুর রব জয়বাংলা শ্লোগান এবং তুমুল করতালির মধ্যে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন।
৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ বটতলায় জমায়েত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে তাদের একাত্মতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন এবং ৭ মার্চ পর্যন্ত তাঁর সংগ্রামের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কিন্তু জনতা তাঁর কাছে তাৎক্ষণিক এবং সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার দাবি জানায়। ছাত্রনেতা এএসএম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী এবং শাহজাহান সিরাজের যৌথ নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে একটি ইস্তেহার বিলি করে। ইস্তেহারের বিষয় ছিল: ‘জয় বাংলা: স্বাধীনতার ঘোষণা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এতদ্বারা ঘোষণা করা হলো। বাংলাদেশ এখন এক স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ।’ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাংলাদেশের জন্য একটি জাতীয় সংগীত নির্বাচিত করে। সেটি হলো রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও সংগীত ‘ও আমার সোনার বাংলা….।’
৪ মার্চ দেশব্যাপী পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। সকল ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অনতিবিলম্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দাবি জানান।
৫ মার্চ এএসএম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং অন্যান্য ছাত্রনেতার নেতৃত্বে ছাত্ররা ঢাকায় এক লাঠি মিছিল বের করে। ড. আহমদ শরীফের নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবী এবং পেশাজীবীরা স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ গ্রহণ করেন।
৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘোষণা দেন যে, ঢাকায় জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসবে ২৫ মার্চ। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল আগের মতই অসহযোগ আন্দোলন পুরোপুরি এবং প্রবলভাবে চালিয়ে যাওয়ার সঙ্কল্প ব্যক্ত করে।
৭ মার্চ, ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ
পটভূমি: ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী এই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করতে শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যে-কোনভাবে ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখা। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে ১লা মার্চ এই অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করেন। এই সংবাদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সারাদেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়। তিনি ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই পটভূমিতেই ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান ১৮ মিনিট স্থায়ী এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বিপুল সংখ্যক লোক একত্রিত হয়; পুরো ময়দান পরিণত হয় এক জনসমুদ্রে। এই জনতা এবং সার্বিকভাবে সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রদান করেন। এই ভাষণে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান।
পূর্ণাঙ্গ ভাষণ: ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস-এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ এর আন্দোলনে আয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গনতন্ত্র দেবেন – আমরা মেনে নিলাম। তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেলো, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলা নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসবো। আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো- এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনও যদি সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম- আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো।
তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলা দেয়া হবে। যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে এসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো। ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।
আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিলো। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।
কী পেলাম আমরা? আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্র“র আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের ওপরে হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি নাকি স্বীকার করেছি যে, ১০ই তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি তো অনেক আগেই বলে দিয়েছি, কিসের রাউন্ড টেবিল, কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার ওপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের ওপরে দিয়েছেন।
ভায়েরা আমার, ২৫ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি, ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারেনা। এসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবী মানতে হবে। প্রথম, সামরিক আইন- মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। আমি, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাঁচারী, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।
গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ারগাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে- শুধু… সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় – তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু – আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবেনা। আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমাদের রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছে দেবেন। আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো- কেউ দেবে না। মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দুমুসলমান, বাঙালী-ননবাঙালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালী রেডিও স্টেশনে যাবে না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়না-পত্র নেবার পারে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সংগে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালীরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, আরো রক্ত দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম জয় বাংলা।
রঙিন ভার্সনে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ
উত্তাল মার্চ : স্বাধিকার আন্দোলনের চুড়ান্ত বিকাশ
৯ মার্চ পল্টন ময়দানে একটি বিশাল জনসভায় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও আতাউর রহমান খান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
১০ মার্চ আতাউর রহমান খান শেখ মুজিবকে অনতিবিলম্বে একটি অন্তবর্তীকালীন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করার আহবান জানান।
১১ মার্চ ইপিসিএস এবং সিএসপি সমিতির বাঙালি সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁদের আনুগত্য ঘোষণা করেন এবং প্রত্যেকের একদিনের বেতন আওয়ামী লীগের তহবিলে দান করেন।
১৪ মার্চ সামরিক বাহিনীর রসদ সরবরাহ বন্ধ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে মালামাল যেতে না দেয়ার উদ্দেশ্যে নগরীর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রতিরোধের প্রস্ত্ততি নিতে শুরু করে।
১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সিনিয়র জেনারেল এবং অফিসারদের নিয়ে ঢাকায় আগমন করেন। একই দিনে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঘোষণা দেন যে, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে স্বাধীন হয়ে গেছে এবং তাদের জন্য বিধিনিয়ম তৈরি করার কোনো আইনসিদ্ধ অধিকার সামরিক বাহিনীর নেই। তারা আরো ঘোষণা দেন যে, বাংলাদেশ অন্য কারো নয়, শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদেশ মেনে চলবে। তারা আসন্ন একটি সশস্ত্র সংগ্রামে শরীক হওয়ার জন্য বাংলাদেশের সব নাগরিককে আহবান জানান।
১৬ মার্চ মুজিবের সাথে ইয়াহিয়ার সংলাপ শুরু হয় যা মাঝেমধ্যে বিরতিসহ ২৫ মার্চ পর্যন্ত চলার কথা।
১৮ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাংলাদেশের স্বাধীনতার নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্বসমাজের প্রতি আহবান জানান।
১৯ মার্চ গাজীপুর সমরাস্ত্র কারখানা এবং জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিকদের মধ্যে খন্ডযুদ্ধ। বিক্ষোভরত জনতার উপর গুলি চালাতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অস্বীকৃতি। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যাতে যানবাহন নিয়ে চলাফেরা করতে না পারে সে জন্য জনতা কর্তৃক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সড়কে ব্যারিকেড স্থাপন। ব্যারিকেড দিতে গিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে বেশ কয়েকজন কর্মী নিহত।
২০ মার্চ চট্টগ্রামে এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবকে প্রধান করে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়ার প্রতি আহবান জানান। তিনি বলেন, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঠিক করবে ভবিষ্যতে স্বাধীন বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে কি ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখবে।
২০-২১ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য প্রধান নেতা ইয়াহিয়া খানের সাথে দেখা করেন এবং বেশ কয়েকবার তাঁর সাথে দীর্ঘ আলোচনায় মিলিত হন। কিন্তু তাতে লক্ষণীয় কোনো অগ্রগতি অর্জিত হয় নি।
২২ মার্চ প্রতিটি জাতীয় সংবাদপত্রে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ছবি প্রকাশিত হয়। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রথাগত পাকিস্তান দিবস পালন প্রত্যাখ্যান করার এবং এর পরিবর্তে প্রতিটি বাড়ির ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করার নির্দেশ দেন।
২৩ মার্চ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের (নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, এএসএম আবদুর রব এবং আবদুর কুদ্দুস মাখন) নেতৃত্বে্ বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা পাকিস্তান দিবস প্রত্যাখ্যান করেন। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় শ্রমিক পরিষদ বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ছাদে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। জয়বাংলা বাহিনী পল্টন ময়দানে স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজের আয়োজন করেন। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতা স্বাধীনতার কুচকাওয়াজের অভিবাদন গ্রহণ করেন। এ সময় পূর্ব রেকর্ডকৃত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বাজানো হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে জয়বাংলা বাহিনীর দশ প্লাটুন এবং একটি ব্যান্ড প্লাটুন পল্টন ময়দান হতে কুচকাওয়াজ করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে পৌছায়। বঙ্গবন্ধু তাদের উদ্দেশে ভাষণ দেন এবং চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত তাদের প্রস্ত্তত থাকার নির্দেশ দেন।
২৪ মার্চ যশোরে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এর হেডকোয়ার্টারে সিপাহীরা জয়বাংলা শ্লোগান দেন এবং বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে অভিবাদন জানান।
২৫ মার্চের গণহত্যা
বন্দর শ্রমিক ও কর্মকর্তারা করাচী থেকে অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই হয়ে চট্টগ্রামে আগত সোয়াত জাহাজ থেকে মালামাল খালাস করতে অস্বীকৃতি জানায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের চলাচলে বাধা সৃষ্টির জন্য চট্টগ্রামবাসী সকল প্রধান সড়কে ব্যারিকেড দেন। ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা সঙ্গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন।
মধ্যরাতে ইয়াহিয়ার নির্দেশে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী ঘুমন্ত ঢাকাবাসী নিরস্ত্র নরনারীর উপর ঝাপিয়ে পড়লে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানার তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্প, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল ও জহরুল হক হল সহ সারা ঢাকা শহরে তারা হত্যাযজ্ঞ চালায়। এক রাতের মধ্যেই ঢাকা শহরকে মৃত্যুকুপ বানিয়ে ফেলে। দৈনিক ইত্তেফাকে গণহত্যা বন্ধ কর নামে হেড লাইনে সংবাদ প্রকাশিত হয়ে এবং ২৭ মার্চে সমগ্র বাঙলাদেশে হরতালের ডাক দেওয়া হয়।
২৫ মার্চের আগে ঢাকা থেকে সব বিদেশী সাংবাদিককে বের করে দেয়া হয়। সে রাতে পাকিস্তান বাহিনী শুরু করে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের হত্যাযজ্ঞ। এই রাতে পাকিস্তান বাহিনী মূলত মূলত ৫টি লক্ষ্যবস্তু টার্গেট করে অপরেশনে নেমেছিল:
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিক, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল্স বাহিনীর লোক, পুলিশ এবং আধা-সামরিক বাহিনীর লোক।
হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক
আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে নিম্নতম পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের লোক, বিশেষ করে এই দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবকগণ।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রী।
অধ্যাপক ও শিক্ষকদের মত প্রগতিশীল বাঙালি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়।
এই কালরাতেই পাকিস্তানি ঘাতক সেনাদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে এই গণহত্যার উল্লেখ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই আক্রমণের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকারের লক্ষ্য ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে অতি স্বল্প সময়ে সেখানে তাদের আনুগত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু ঢাকার ভিতরে নির্বিচার হত্যকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকার বাইরে ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয় যার পরিণতিতে সারা বাংলার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে।
২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা
২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন ঘুমন্ত বাঙালি জাতির উপর ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা শুরু করে তখন ধানমণ্ডির ৩২ নং বাড়িতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ নেতাদের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করেন। ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়্যারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরিত হয়।
এভাবে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চবাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্ম হয় এবং শুরু হয় বাঙালি জাতির সর্বকালের শ্রেষ্ট ঘটনা‘মুক্তিযুদ্ধ’যা ৩০ লক্ষ শহীদের প্রাণ ও তিন লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে নয় মাস পর ১৬ ডিসেম্বর চুড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে শেষ হয়।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। ২৭ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মীদের অনুরোধে সে সময়ের মেজর জিয়াউর রহমানও একই বেতারকেন্দ্র থেকে এই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।
বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ছিল নিম্নরূপ: ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আমার আহবান, আপনারা যে যেখানেই থাকুন এবং যার যা কিছু আছে তা দিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করুন। বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বিতাড়িত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের এ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান পরদিন (২৭ মার্চ) চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন:
‘আমি মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির অস্থায়ী প্রধান সেনাপতি এতদ্বারা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।’
‘আমি আরও ঘোষণা করছি, আমরা ইতোমধ্যে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে একটি সার্বভৌম ও বৈধ সরকার গঠন করেছি, যে সরকার আইনবিধান ও শাসনতন্ত্র অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। নতুন গণতান্ত্রিক সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোটনিরপেক্ষ নীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই সরকার সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার এবং আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে। আমি সকল দেশের সরকারকে বাংলাদেশে নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের নিজ নিজ দেশে জনমত গড়ে তোলার আহবান জানাই। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌম ও বৈধ সরকার এবং এ সরকার বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।’
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার দলিলপত্র
স্বাধীনতার ঘোষক কে! তা নিয়ে ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর কখনো কোনো বিতর্ক বা দ্বিমত কেউ পোষন করেনি। মেজর জিয়াউর রহমান জীবিত থাকা অবস্থায় কখনো নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে দাবি করেনি। বরং জীবিতকালে তিনি তার লেখা, বক্তব্যে ও সাক্ষাতকারে বঙ্গবন্ধুকেই স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ইতিহাস বিকৃত করে বিষয়টিকে বিতর্কিত করে তোলে। যদিও ‘স্বাধীনতার ঘোষক শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’-এটি এখন মহামান্য উচ্চ আদালত ও গবেষক দ্বারা প্রমানিত ও মীমাংসিত বিষয়। তারপরেও অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের সুবিধার্থে এখানে কিছু গুরুত্ত্বপূর্ণ দলিলপত্র দেখানো হল।
বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতা ঘোষণার খবর প্রকাশ করে পাকিস্তানের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক দ্য ডন। এছাড়াও বেশ কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম খবরটি প্রকাশ করে। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালকানারী স্বাধীনবাংলা সরকারও এই ঘোষণাটি প্রচার করে বিভিন্ন দেশে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এবিসি নিউজে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর
CBS, Mar 26, 1971
“A clandestine radio station calling itself the “Voice of Independent Bengal” broadcast that Rahman has declared East Pakistan an Independent Nation.”
এখানে খবরে বলেছে যে একটি গোপন রেডিও স্টেশন যারা নিজেদের “ভয়েস অফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট বেঙ্গল” হিসেবে বলছে তারা প্রচার করছে যে রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
স্বাধীনতার ঘোষণার খসড়া রচনা ও পাঠ
গণহত্যার প্রাক্কালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ নিরাপত্তার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। ১০ এপ্রিল জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের অনেক নির্বাচিত সদস্য কোলকাতায় সমবেত হয়ে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একটি প্রবাসী গণপরিষদ গঠন এবং স্বাধীনতার ঘোষণার খসড়া রচনা করেন। ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলায় (ঘোষণার পর এর নামকরণ হয় মুজিবনগর) আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘোষণা গৃহীত হয়। জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
ঘোষণাপত্রের পূর্ণ বিবরণ
মুজিবনগর, বাংলাদেশ
তারিখ: ১০ এপ্রিল ১৯৭১
যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল; এবং
যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল;
এবং
যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন; এবং
যেহেতু তিনি আহূত এই অধিবেশন স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন; এবং
যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারষ্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন; এবং
যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান; এবং
যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং এখনও বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে; এবং
যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্য এবং নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনার দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের পক্ষে একত্রিত হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব কে তুলেছে; এবং
যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে;
সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারষ্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে
বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি; এবং
এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন; এবং
রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন; ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী থাকবেন; এবং
তাঁর কর ধার্য ও অর্থব্যয়ের ক্ষমতা থাকবে; এবং
বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষমতারও তিনি অধিকারী হবেন।
বাংলাদেশের জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, কোনো কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করতে না পারেন অথবা তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যদি অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রদত্ত সকল দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসাবে এবং জাতিসংঘের সনদ মোতাবেক আমাদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তেছে তা যথাযথভাবে আমরা পালন করব। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য আমরা অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলীকে যথাযথভাবে রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য দায়িত্ব অর্পণ ও নিযুক্ত করলাম।
স্বাক্ষর: অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলী
বাংলাদেশ গণপরিষদের ক্ষমতা দ্বারা
এবং ক্ষমতাবলে যথাবিধি সর্বাধিক ক্ষমতাধিকারী।
আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ ১৯৭১
বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে একই দিনে আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ নামে একটি আদেশ জারি করেন। স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে সকল আইন চালু ছিল, তা রক্ষার্থে এটা করা হয়।
মুজিবনগর, বাংলাদেশ
১০ এপ্রিল, ১৯৭১
আমি, বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপতি এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে এ আদেশ জারী করছি যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে সকল আইন চালু ছিল, তা ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একইভাবে চালু থাকবে, তবে প্রয়োজনীয় সংশোধনী সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের জন্য করা যাবে। এই রাষ্ট্রগঠন বাংলাদেশের জনসাধারণের ইচ্ছায় হয়েছে। এক্ষণে, সকল সরকারি, সামরিক, বেসামরিক, বিচার বিভাগীয় এবং কূটনৈতিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী যারা বাংলাদেশের প্রতি অনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছেন, তারা এতদিন পর্যন্ত নিয়োগবিধির আওতায় যে শর্তে কাজে বহাল ছিলেন, সেই একই শর্তে তারা চাকুরিতে বহাল থাকবেন। বাংলাদেশের সীমানায় অবস্থিত সকল জেলা জজ এবং জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট এবং সকল কুটনৈতিক প্রতিনিধি যারা অন্যত্র অবস্থান করছেন, তারা সকল সরকারি কর্মচারীকে স্ব স্ব এলাকায় আনুগত্যের শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা করবেন।
এই আদেশ ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য করতে হবে।