১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল স্থানীয় সময় রাত ১টা ২৩ মিনিটে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেন প্রজাতন্ত্রে অবস্থিত চেরনোবিল পারমাণবিক স্থাপনার চতুর্থ চুল্লিতে দুর্ঘটনা ঘটে। এ পারমাণবিক দুর্ঘটনাকে এ পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে।
এক নজরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র
[জেনারেটরের একটি বিশেষ অংশ মোটর, ইজ্ঞিন বা অন্য কোনো উপায়ে ঘোরালে পরিবর্তী বৈদ্যুতিক ভোল্টেজ (alternating current) সৃষ্টি হয়। এই ব্যবস্থা যান্ত্রিক শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপাণ্তরিত করে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পারমাণবিক চুল্লিতে (Nuclear Reactor) তেজস্ক্রিয় আইসোটেপের দহনে তাপ উৎপন্ন হয়। উৎপন্ন তাপ বয়লার সিস্টেমের মাধ্যমে পানিকে বাষ্পীভূত করে। উৎপাদিত বাষ্প স্টিম টারবাইনকে সক্রিয় করে। টারবাইনের সঙ্গে যুক্ত জেনারেটর বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।অর্থাৎ সহজভাবে বলা যায়, বিশেষ তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে তাপ সৃষ্টি করা হয়। সেই তাপ দিয়ে পানিকে বাষ্পে পরিণত করা হয়। বাষ্পচালিত টারবাইন জেনারেটরের বিশেষ অংশটিকে ঘোরাতে ঘোরাতে থাকে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান হচ্ছে রিয়েক্টর ভ্যাসেল। তাই এই স্থানটি পুরু কনক্রিট দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় (ছবিতে: containment structure) যাতে তেজস্ক্রিয়তা বের হতে না পারে।]
সাবমেরিন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারের সমসাময়িক সময়ে চেরনোবিল দুর্ঘটনা প্রথমবারের মত সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আওতাধীন ইউক্রেন ও বেলারুশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ওই দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। ঘটনাটি ঘটে মূলত নিরাপদ শীতলীকরণের উপর একটি সাধারণ পরীক্ষা চালানোর সময়, কর্তৃপক্ষের ভাষ্য মতে, কর্তব্যরত কর্মীদের অবহেলার কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটে। যদিও এই দুর্ঘটনার পেছনে আরো অনেক কারণ নিহিত ছিল।
দুর্ঘটনাটি মূলত ঘটেছিলো নিরাপদ শীতলীকরণের উপর একটি পরীক্ষা চালানীর সময়। রাতের শিফটে দায়িত্বরত কর্মীদের শীতল পানি সরবরাহে ভুলত্রুটির কারণে রিয়েক্টর ভ্যাসেল অতি মাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে উঠে এবং এক পর্যায়ে প্রচন্ড বিস্ফোরন ঘটে। পরপর প্রায় একই সঙ্গে দুটি বিস্ফোরণে বিদ্যুৎকেন্দ্রের চতুর্থ রিয়্যাক্টরের উপরের প্রায় এক হাজার টন ওজনের কংক্রীটের ঢাকনা সরে যায় এবং ছাদ ভেঙে যাওয়ার ফলে এক বিশাল গহ্বরের সৃষ্টি হয়। দুর্ঘটনার ২০ ঘন্টা পর বাইরের বাতাস ঢুকে রিয়্যাক্টরের দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে সেখানে বিরাট অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়। এ আগুন ১০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এতে করে পারমাণবিক বিক্রিয়ায় তৈরি তেজস্ক্রিয় বর্জ্য প্রায় ১ কিলোমিটার উঁচু অবধি ছড়িয়ে পড়েছিল এবং প্রচুর তেজস্ক্রিয় ধুলো পরিবেশে দূষণ ছড়িয়েছিল। এই দুর্ঘটনার ফলে উদ্ভূত পারমাণবিক ভাবে সক্রিয় (তেজস্ক্রিয়) মেঘ ইউক্রেন, বেলোরাশিয়া, রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে, গ্রেট ব্রিটেনে এমন কি পূর্ব আমেরিকার উপরেও গিয়েছিল। দুর্ঘটনার জন্য কর্তব্যরত কর্মীদেরই দায়ী করা হয়ে থাকে। কিছু নিরাপত্তা ব্যবস্থা বন্ধ ছিলো এবং রিয়্যাক্টরটি অনুপযুক্ত অবস্থায় চালানো হচ্ছিলো, যার ফলে শক্তি নির্গমন অতিরিক্ত বেড়ে যায়। বিস্ফোরণে বেশ কয়েকজন মারা ও অনেক মানুষ তেজস্ক্রিয়তার শিকার হলে সকল অধিবাসীকে ওই অঞ্চল থেকে সরিয়ে নেয়া হয়।
ঘটনার সময় চেরনোবিলে প্রায় ১৪ হাজার বসতি ছিল। দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই ৪ জন কর্মী মারা যান। পরবর্তীতে ২৩৭ জন মানুষ পারমাণবিক বিকিরণের ফলে অসুস্থ হয়ে পরে এবং প্রথম তিন মাসে ৩১ জন মৃত্যুবরণ করে, যাদের অধিকাংশই উদ্ধারকর্মী। সরকারি তথ্যমতে, দুর্ঘটনার কারণে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ লোক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে ছিল ছয় লক্ষ শিশু। এই দুর্ঘটনার ফলে ২০০ বিলিয়ন ডলারের সমমান ক্ষতি হয়েছিল।বর্তমানে চেরনোবিল শহরটি পরিত্যক্ত এবং প্রায় ৫০ মাইল এলাকা জুড়ে বলতে গেলে কেউ বাস করে না।
দুর্ঘটনার প্রায় ৩০ বছর পর আজও চেরনোবিল এলাকা মানুষ শূণ্য। সম্প্রতি একদল গবেষক চেরনোবিল এলাকা পরীক্ষা করেন সম্ভ্যাব্য ক্ষতি পরিমান নিরুপনের জন্য। কিন্তু চেরনোবিল পরীক্ষা করার পর গবেষকরা জানিয়েছেন যে, চেরনোবিল এলাকা এখনও তেজস্ক্রিয় পদার্থের কারণে উত্তপ্ত অবস্থায় আছে। বিস্ফোরণ স্থলের ৩০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে এখনও নির্ধারিত পোশাক ছাড়া কারও প্রবেশ নিষেধ করেছে দুই দেশের সরকার। বিস্ফোরণের আগে ওই অঞ্চলে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের বসবাস ছিল।
পারমাণবিক দূষণ থেকে পরিবেশকে সংরক্ষণ করতে একটি বিশাল কংক্রীটের খোলসের মধ্যে দুর্ঘটনাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া চতুর্থ রিয়্যাক্টর কে ছয় মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ ভাবে ঢেকে ফেলা হয়। ওই অস্থায়ী নিরাপত্তাব্যবস্থাই এখন পর্যন্ত পারমাণবিক কেন্দ্রটির ধ্বংসাবশেষকে আটকে রাখার জন্য নির্মিত একমাত্র স্থাপনা। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, চেরনোবিলের ধ্বংসাবশেষে থাকা গলিত প্রায় ২০০ টন পরমাণু জ্বালানি থেকে যে ভয়াবহ তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়েছে তা হাজার বছরেও সম্পূর্ণ দূর হবে না। তাই এ পরমাণু জ্বালানি বাইরের পরিবেশের আওতামুক্ত রাখতে নতুন একটি নিরাপত্তা স্থাপনা নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। উচ্চাভিলাষী স্থাপনাটির নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে ১৬০ কোটি ইউরো বা ২২১ কোটি ডলার।
সূত্র: ইন্টারনেট, উইকিপিডিয়া, পত্রপত্রিকা
awesome website that is!!