১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়েছিল এবং ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছিল। বাংলাদেশের সংবিধান স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ষোড়শ সংশোধনী সহ এটির মোট ১৬টি সংশোধনী রয়েছে। এই সংবিধান পরিবর্তনের জন্য কিংবা সংশোধনের প্রয়োজন হলে সংসদ সদস্যদের দুই তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন হয়।
প্রথম সংশোধনী: ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের প্রথম সংশোধনী পাস হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে ৪৭ অনুচ্ছেদে দুটি নতুন উপধারা সংযোজন করা হয়। এ সংশোধনীর মূল কারণ ছিল গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য আইন তৈরি এবং তা কার্যকর করা।
দ্বিতীয় সংশোধনী: ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় সংশোধনী পাস হয়। এতে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৬, ৬৩, ৭২ ও ১৪২-কে সংশোধন করা হয়। নিবর্তনমূলক আটক, জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও এ সময় মৌলিক অধিকারগুলো স্থগিতকরণ সম্পর্কে প্রথমদিকে সংবিধানে কোনো বিধান ছিল না। এ সংশোধনীর মাধ্যমে বিধানগুলো সংযোজন করা হয়। এর ফলে প্রেসিডেন্ট দেশে জরুরী অবস্থা জারী করতে পারবেন। আর তখন সংবিধানে বর্ণিত কিছু মৌলিক অধিকার রাষ্ট্রের জনগণ ভোগ করতে পারবে না।
তৃতীয় সংশোধনী: ১৯৭৪ সালের ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী পাস হয়। মূলত ভারত ও বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারণ ও ছিটমহল বিনিময়ের জন্য তৃতীয় সংশোধনী আনা হয়।
চতুর্থ সংশোধনী: ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি এ সংশোধনীর মাধ্যমেই বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো হয়। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় পদ্ধতি পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করা; একদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা; রাষ্ট্রপতি ও সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং সকল ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে প্রদান করা; মৌলিক অধিকার বলবৎ করার অধিকার বাতিল করা; বিচার বিভাগের কিছু স্বাধীনতা রহিত করা ও উপ-রাষ্ট্রপতির পদ সৃষ্টি করা হয়। ১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাতিল হয়ে যায়।
পঞ্চম সংশোধনী: ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পাস হয়। এ সংশোধনী ১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্টে সামরিক শাসন জারির পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সামরিক শাসনামলের সব আদেশ, ঘোষণা, দণ্ডাদেশ, আইন ও কার্যকলাপকে বৈধ ঘোষণা করা হয়। যেটি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নামে বেশি পরিচিত। এ সংশোধনীটি পরে উচ্চ আদালতের রায়ে বাতিল হয়।
ষষ্ঠ সংশোধনী: ১৯৮১ সালের ১০ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের ষষ্ঠ সংশোধনী পাস হয়। এতে সংবিধানের আর্টিকেল ৫১ ও ৬৬ কে সংশোধন করে বলা হয় যে, রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীগণের অফিস হবে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান।
সপ্তম সংশোধনী: ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী পাস হয়। এতে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের সামরিক শাসন, সকল অর্ডিন্যান্স, আইন ও কার্যকলাপকে বৈধ ঘোষণা করা হয়। আর বিচারপতিদের অবসরের বয়স সীমা ৬২ থেকে ৬৫ তে বাড়ানো হয়। ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট এ সংশোধনী আদালতে কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত হয়।
অষ্টম সংশোধনী: ১৯৮৮ সালের ৯ জুন বাংলাদেশ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী পাস হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ ২, ৩, ৫, ৩০ ও ১০০ তে পরিবর্তন আনা হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বলে ঘোষণা করা হয়, ঢাকার বাইরে হাই কোর্ট বিভাগের ৬টি স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করা হয়। Dacca-এর নাম Dhaka এবং বাঙালিকে বাংলাদেশি -তে পরিবর্তন করা হয়।
তবে হাই কোর্টের বেঞ্চ গঠনের বিষয়টি বাতিল করে সর্বোচ্চ আদালত।
নবম সংশোধনী: ১৯৮৯ সালের ১১ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের নবম সংশোধনী পাস হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতিকে নিয়ে কিছু বিধান সংযোজন করা হয়। এ সংশোধনীর আগে রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি যতবার ইচ্ছা রাষ্ট্রপতি পদের জন্য নির্বাচন করতে পারতেন। এ সংশোধনীর পর দুই টার্মের বেশি কেউ প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতে ভাইস প্রেসিডেন্ট হবেন প্রেসিডেন্ট।
দশম সংশোধনী: ১৯৯০ সালের ১২ জুন বাংলাদেশ সংবিধানের দশম সংশোধনী পাস হয়। এতে নারীদের জন্য সংসদে আসন ১৫ থেকে ৩০ এ বাড়ানো হয়।
একাদশ সংশোধনী: গণঅভ্যুত্থানে এইচ এম এরশাদের পতনের পর বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দিনের দায়িত্ব গ্রহণনিয়ে ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট বাংলাদেশ সংবিধানের একাদশ সংশোধনী পাস হয়। এর মাধ্যমে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগদান বৈধ ঘোষণা করা হয়। এতে আরো বলা হয়, নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর এ উপরাষ্ট্রপতি দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করতে পারবেন এবং উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে তার কর্মকাল বিচারপতি হিসেবে হিসেবে গণ্য হবে।
দ্বাদশ সংশোধনী: ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পাস হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৭ বছর পর দেশে পুনরায় সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকারের পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার প্রবর্তন করে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ রহিত করা হয়।
ত্রয়োদশ সংশোধনী: ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে নির্বাচনকালীন সময়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। নির্বাচনকালীন সময়ে দেশে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করবে। যে সরকারে একজন প্রধান উপদেষ্টা থাকবেন, যিনি হবেন সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। আর ১০ জন হবেন নিরপেক্ষ উপদেষ্টা।
চতুর্দশ সংশোধনী: ২০০৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশ সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী পাস হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ থেকে ৪৫ করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ বছর করা হয়।এছাড়া রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি এবং সরকারি ও আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিকৃতি বা ছবি প্রদর্শনের বিধান করা হয়।
পঞ্চদশ সংশোধনী: ২০১১ সালের ৩ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের পাশাপাশি অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ বিবেচনায় সর্বোচ্চ দণ্ডের বিধান রাখা হয়। ৭২’র সংবিধানের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংবিধানের সংরক্ষিত মহিলা আসন ৪৫ থেকে ৫০-এ বাড়ানো হয়।
ষোড়শ সংশোধনী: ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। এর মধ্য দিয়ে ৪০ বছর পর সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে ন্যস্ত হলো। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে দফা ২-এ বলা হয়েছে, প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্যসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠ সদস্যের প্রস্তাবক্রমে রাষ্ট্রপতির আদেশে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণ করা যাবে। ৩ দফায় বলা হয়েছে, সাংসদদের প্রস্তাব-সম্পর্কিত এবং বিচারকের অসদাচরণ ও অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। ৪ দফায় বলা হয়েছে, কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করতে পারবেন।
এর আগে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে ন্যস্ত হয়েছিল। এরপর সামরিক ফরমানের দ্বারা পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়।
তথ্যসূত্র: বিভিন্ন সংবাদপত্র, উইকিপিডিয়া