বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ১৮ ডলার থেকে বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন

পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরের ইতিহাসে বিশ্ববাসী পূর্ব পাকিস্তানের শুধু নেতিবাচক খবর দেখে এসেছে। যেমন বন্যা , খরা, সাইক্লোন, মহামারী, অভাব-দুর্যোগ ইত্যাদি। জনসংখ্যার ভারে নুয়ে পড়া এই ছোট দেশটির কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, শুধু আছে অনবরত প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর দারিদ্রতার অনমন। তাই সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এ দেশটির ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহের অন্ত ছিল না অনেকের। সংশয়বাদীদের কেউ কেউ এমনও পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, এ দেশটি বেশিদিন টিকবে না। বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা সদ্যপ্রসূত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শুধু হতাশার বাণী শুনিয়েছিলেন।

বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্ব ব্যাংকের প্রথম রিপোর্ট ছিল খুবই নেতিবাচক। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি জাস্ট ফালেন এবং তার এক সহযোগী লিখেছিলেন, “বাংলাদেশের জিওগ্রাফি ঠিক আছে, কিন্তু অর্থনীতি ঠিক নেই। এই দেশের অর্থনীতি টেকসই করতে দুশো বছর সময় লাগবে।” বিশ্ব ব্যাংকের সেই বহুল উদ্ধৃত রিপোর্টে আরও বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের যদি উন্নয়ন সম্ভব হয়, আফ্রিকা-সহ বিশ্বের যে কোন দেশেরই উন্নয়ন সম্ভব।

বাংলাদেশ শুরু করেছিল মাত্র ১৮ ডলার দিয়ে। পাকিস্তানীরা চলে যাওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঢাকা অফিসে রেখে গিয়েছিল ১৮ ডলার।” -বিবিসির সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডঃ মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বৈদেশিক সাহায্য/ঋণের ব্যর্থ প্রচেষ্টা

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেই বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেন। এই কমিশনের সদস্য ছিলেন সেসময়ের বাংলাদেশের খ্যাতিমান চার তরুণ অর্থনীতিবিদ: অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান এবং মোশাররফ হোসেন। “মুক্তিযুদ্ধে আমরা জিতেছি। এখন দ্বিতীয় যুদ্ধ: পুনর্বাসন ও পুর্নগঠন, অর্থনীতি আবার চালু করা, মানুষের অন্নের সংস্থান করা।” -লক্ষ্য নিয়ে কাজে নামলেন পরিকল্পনা কমিশন।

এরকম এক সময়ে একবার তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এবং পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন খাদ্য সাহায্য চাইতে। সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে নুরুল ইসলাম বলেন, “যখন আমরা ওয়াশিংটনে গেলাম, তখন ওরা আমাদের বিরাট লেকচার দিল। বললো, তোমরা পাকিস্তানের সঙ্গে মিটমাট করে নাও। তাজউদ্দিন সাহেব তো রীতিমত শকড। আমরা গেছি সাহায্য চাইতে, ওরা বলে পাকিস্তানের সঙ্গে মিটমাট করে নাও।” নেতিবাচক রিপোর্ট দেওয়া স্বত্বেও এবার উনারা বিশ্বব্যাংকের কাছে গেলেন। বিশ্বব্যাংক তখন এমন কিছু বিষয় তুলছিল, যা বাংলাদেশকে ভীষণ ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। এর মধ্যে একটি ছিল, পাকিস্তানকে দেয়া বিশ্বব্যাংকের ঋণের দায়ভাগ নেয়ার প্রশ্ন। অধ্যাপক ইসলাম বলেন, “‌ওরা বলছিল, পাকিস্তানকে যে ঋণ দেয়া হয়েছে, সেটার দায়ভাগ আমাদেরও নিতে হবে। আমরা বললাম, আমরা কেন নেব, ওরা তো আমাদের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করেছে। তখন ওরা বললো, সেটা তোমাদের ইন্টারন্যাল ব্যাপার। আমাদের টাকা ফেরত দিতে হবে।” শেষ পর্যন্ত ফয়সালা হয়েছিল, বাংলাদেশ কেবল সেই ঋণের অংশই পরিশোধ করবে, যেসব প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে গেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ কোনো দেশ বা সংস্থা থেকে বৈদেশিক ঋণ বা সাহায্য তো পায়নি, উল্টো পাকিস্তান আমলের বৈদেশিক ঋণের কিছু দেনা মাথায় নিয়ে ফেরত আসতে হলো। এভাবেই শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য পাওয়ার চেষ্টা।


Link: World Bank Data Bangladesh

যাই-হোক, ১৯৭২ থেকে ২০২১ এই দীর্ঘ ৫০ বছরে অনেক বাঁধা-বিপত্তি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রাজনৈতিক পরিবর্তন, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের মত প্রতিকুলতা অতিক্রম করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ১৮ ডলার থেকে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এই অর্জনের পেছনে সরকার প্রধান থেকে শুরু করে পরিকল্পনাবিদ, শিল্পদ্যোক্তা, গার্মেন্টস কর্মী, প্রবাসী বাংলাদেশি এবং দেশের কৃষক-শ্রমিক অনেকের অবদান রয়েছে। ১৯৭২ থেকে ২০২১ সালের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়:

  • বৈদেশিক মুদ্রার মজুত প্রথমবারের মতো মিলিয়ন অতিক্রম করে বিলিয়নে উঠে ১৯৮৮ সালে।
  • মজুত বেড়ে ৩ বিলিয়নে হয় ১৯৯৪ সালে, ৫ বিলিয়নে হয় ২০০৭ সালে।
  • মজুত ২০০৮ সালে ছিল ৬ বিলিয়ন যা দ্রুতগতিতে বেড়ে ২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়নে উপনীত হয়েছে।
  • রিজার্ভ ১ বিলিয়নে আসতে সময় লেগেছে, ১৮ বছর, ১ বিলিয়ন থেকে ৫ বিলিয়নে যেতে লেগেছে আরো ১৯ বছর।
  • ২০০৮ সালের ৬ বিলিয়ন থেকে ২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়ন হতে সময় লেগেছে মাত্র ১৬ বছর।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি (২০০৮ – ২০২১) এই ষোল বছরে অনেকটা আগের মতই ছিল। অর্থাৎ হরতাল-অবরোধ, রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, শ্রমিক অসন্তোষ, বন্যা-সাইক্লোন তো ছিলই, নতুনভাবে যোগ হয়েছিল পেট্রোল বোমা, আগুন সন্ত্রাস ও করোনা মহামারী। তারপরেও অপ্রতিরোধ্য গতিতে রিজার্ভ বাড়ার উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হচ্ছে:

  • ক্ষমতায় একই সরকারের ধারাবাহিকতা,
  • দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন করতে পারা,
  • সার্বিক অবকাঠামোর উন্নয়ন,
  • বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি,
  • ব্যবসাবান্ধব পলিসি,
  • গার্মেন্টস ও রেমিট্যান্সের অনুকূলে সরকারি সহায়তা
  • রেমিট্যান্সে প্রণোদনা

কয়েকটি দেশের সাথে রিজার্ভের তুলনামূলক চিত্র ২০০০ – ২০২০ সাল


Link: World Bank Data Compare

রিজার্ভে মালেয়শিয়া ও ভিয়েতনাম বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে থাকলেও বিগত ১২ বছরে মজুত বৃদ্ধির হার বাংলাদেশের বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র অনুযায়ী, দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিয়ে। স্বর্ণ, বৈদেশিক মুদ্রা ও ডলার এ তিন ক্যাটেগরিতে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখা হয় দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে। এই অর্থ বিভিন্ন দেশের বন্ড ও বিলে বিনিয়োগ করা হয়। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচাও করে বাংলাদেশ।

২০২১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান বলেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। প্রতি ডলার ৮৫ টাকা হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রায় রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় চার লাখ আট হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের অর্ধেকের বেশি। চলতি বছরে বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে লকডাউনসহ নিয়ন্ত্রণমুলক নানা বিধিনিষেধে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ব্যাহত হলেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চলতি অর্থবছরে ৫২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রক্ষেপণ করেছে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুটি খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক ও প্রবাসী জনশক্তি। দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগের বেশি আসে তৈরি পোশাক থেকে। আর রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। দেশের জিডিপিতে ১২ শতাংশের মতো অবদান রাখে বিদেশে থাকা ১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশির পাঠানো অর্থ।

তথ্য ও ছবিসূত্র:
মাত্র ১৮ ডলার দিয়ে যেভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির যাত্রা শুরু – BBC bangla, 17 dec, 2021
বিশ্ব ব্যাংক, আই এম এফ
প্রথম আলো, ইত্তেফাক, বণিক বার্তা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।