বাগল, যোগেশচন্দ্র

বাগল, যোগেশচন্দ্র (১৯০৩-১৯৭২)  গবেষক, লেখক। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মে পিরোজপুর জেলার কুমিরমারা গ্রামে মাতুলালয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ওই জেলারই চলিশাগ্রামে। রামচরণ দে’র পাঠশালায় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠগ্রহণ শেষে তিনি কদমতলা জর্জ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বাগেরহাট কলেজ (বর্তমান প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ) থেকে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে আইএ পাস করেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বিএ পাস করে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ শ্রেণিতে ভর্তি হন, কিন্তু আর্থিক কারণে লেখাপড়া সমাপ্ত করতে পারেননি।

যোগেশচন্দ্র ছাত্রজীবনেই  অশ্বিনীকুমার দত্ত, কামাখ্যাচরণ নাগ প্রমুখের সংস্পর্শে এসে স্বদেশী চিন্তায় প্রভাবিত হন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে  প্রবাসী ও মডার্ন রিভিউ পত্রিকার প্রুফরিডার হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। পরে এর সহসম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সে সময়ে ব্রজেন্দ্রনাথ দাস, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাস ও নীরদচন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। ১৯৩৫ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত তিনি দেশ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

যোগেশচন্দ্র মূলত জাতীয় বিষয়ে লিখতেন। গবেষণার মাধ্যমে উপাদান ও উপকরণ সংগ্রহ করে তিনি উনিশ শতকের বঙ্গীয় ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করেছেন। পুরনো দলিলপত্র, নথি, প্রতিষ্ঠানের কার্যবিবরণী ও সাময়িক পত্রিকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তিনি বহু মনীষী ও প্রতিষ্ঠানের পরিচয় উদ্ধার করেছেন। ইন্ডিয়ান হিস্টরিকাল রেকর্ডস কমিশন,  বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, রিজিওনাল রেকর্ডস কমিশন অব ওয়েস্টবেঙ্গল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর সংযোগ ছিল।

যোগেশচন্দ্রের রচিত বাংলা গ্রন্থ একুশটি এবং ইংরেজি চারটি। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: জীবনীভিত্তিক ভারতের মুক্তিসন্ধানী (১৯৪০), ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা (১৯৪১), প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক বাংলার নব্যসংস্কৃতি (১৯৫৮), বিদ্যাসাগর পরিচয় (১৯৫৯), কলিকাতায় সংস্কৃতিকেন্দ্র (১৯৫৯); জাতীয় চেতনামূলক হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত (১৯৪৫), দি হিস্ট্রি অব দি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (১৯৫৩), জাগৃতি ও জাতীয়তা (১৯৫৯); নারীজাগরণ বিষয়ক বাংলার স্ত্রীশিক্ষা (১৯৫০), দি উইমেন্স এডুকেশন ইন ইস্টার্ন ইন্ডিয়া (১৯৫৬); শিশুসাহিত্য সাহসীর জয়যাত্রা (১৯৩৮), জাতির বরণীয় যাঁরা (১৯৪৩) ইত্যাদি। তাঁর আত্মজীবনীর নাম বরণীয় (১৯৫৯)।

ভারতের মুক্তিসন্ধানী গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে যোগেশচন্দ্র সুধীমহলে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত গ্রন্থটিও তাঁকে বিপুল খ্যাতি এনে দেয়। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে দৃষ্টিহীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি গবেষণা ও লেখালেখির কাজে নিযুক্ত ছিলেন। দৃষ্টিহীন অবস্থায়ও তিনি যথেষ্ট কাজ করেছেন। হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত গ্রন্থটি তিনি এ অবস্থায়ই পরিমার্জনা করেন এবং ভারতকোষ ও সাহিত্য সাধক চরিতমালার কাজও করেন। এ সময় তিনি ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থটিও সম্পাদনা করেন। যোগেশচন্দ্র ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে ‘বিদ্যাসাগর স্মৃতি বক্তৃতা’ এবং ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ‘শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বক্তৃতা’ প্রদান করেন।

সাহিত্য ও গবেষণার ক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ যোগেশচন্দ্র বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের রামপ্রাণ গুপ্ত পুরস্কার (১৯৫৬), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক (১৯৬২) এবং অমৃতবাজার পত্রিকার শিশিরকুমার পুরস্কারে (১৯৬৬) ভূষিত হন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।  [সৌমিত্র শেখর]