গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য
পতঙ্গবিশারদ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য
জন্ম(১৮৯৫-০৮-০১)১ আগস্ট ১৮৯৫
মৃত্যু৮ এপ্রিল ১৯৮১(1981-04-08) (বয়স ৮৫)
নাগরিকত্বব্রিটিশ ভারতীয় (১৮৯৫-১৯৪৭)
ভারতীয় (১৯৪৭-১৯৭১)
পুরস্কাররবীন্দ্র পুরস্কার, ১৯৭৫
আনন্দ পুরস্কার, ১৯৬৮
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্রপতঙ্গবিশারদ, উদ্ভিদবিদ
প্রতিষ্ঠানসমূহবসু বিজ্ঞান মন্দির, কলকাতা
স্বাক্ষর

গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য (১ আগস্ট ১৮৯৫ – ৮ এপ্রিল ১৯৮১) একজন বাঙালি পতঙ্গবিশারদ ও উদ্ভিদবিদ, যিনি সামাজিক কীটপতঙ্গের ওপর তার গবেষণাকর্মের জন্য বিখ্যাত। বাংলার কীটপতঙ্গ নামক গ্রন্থটি রচনার জন্য[১] ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে তিনি করে দেখ নামক তিন খন্ডের একটি গ্রন্থও রচনা করেন।

প্রথম জীবন[সম্পাদনা]

গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দের পয়লা আগস্ট ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির [ বর্তমান শরিয়তপুর, নড়িয়া, নড়িয়া পৌরসভার ] অন্তর্গত লোনসিং নামক গ্রামে এক দরিদ্র কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা অম্বিকাচরণ ভট্টাচার্য একজন গ্রাম্য পুরোহিত ও মাতা শশীমুখী দেবী একজন গৃহবধু ছিলেন। গোপালচন্দ্রের পাঁচ বছর বয়সে অম্বিকাচরণ মৃত্যুবরণ করলে দারিদ্র্যে মধ্যে তার শৈশব অতিবাহিত হয়। বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করার পর গোপালচন্দ্র যখন ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে কলেজে আই.এ. পড়ার জন্য ভর্তি হলেও অর্থের অভাবে তার পাঠ্যক্রম শেষ করা হয়ে ওঠে নি। এরপর তিনি একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সময় তিনি সাহিত্যচর্চায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন এবং পালা গান ও জরি গানে ইত্যাদি লোকগীতির জন্য গান রচনা করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন হাতে লেখা পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করতেন।

১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রবাসী পত্রিকায় একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে টেলিফোন অপারেটর হিসেবে কাজ করার সময় প্রবাসী পত্রিকায় জৈবদ্যুতি নামক তার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে তা জগদীশচন্দ্র বসুর নজরে আসে। জগদীশচন্দ্র তাকে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞান মন্দিরে মেরামতির কাজে নিযুক্ত করেন। এই প্রতিষ্ঠানে থেকেই তিনি জীববিদ্যার ওপর গবেষণা শুরু করেন।

গবেষণা কর্ম[সম্পাদনা]

১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম উদ্ভিদের জীবনের ওপর তার গবেষণা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত হয়। এরপর জৈব-আলোকবিদ্যার ওপর তার বিভিন্ন গবেষণা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও ধীরে ধীরে কীট পতঙ্গের ওপর তার আগ্রহ জন্ম নেয়। এই সময় তিনি আলোকচিত্রগ্রাহক হিসেবে দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং পিঁপড়ে, মাকড়শা, ব্যাঙাচি, বাদুড় প্রভৃতি প্রাণীর আলোকচিত্র তুলতে শুরু করেন।[২]

১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে বোস ইসস্টিটিউটের পত্রিকায় তিনি দেখান যে পিঁপড়ে ও মৌমাছির মতো সামাজিক কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে কীভাবে রাণী লার্ভার খাদ্যের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সঠিক ভাবে পরিবর্তন করে অন্য রাণী, কর্মী ও সৈনিক পতঙ্গ সৃষ্টি করেন। পিঁপড়ের জন্য স্বচ্ছ বাসা বানিয়ে চুপচাপ নিরীক্ষণ করে তিনি এই পর্য্যবেক্ষণ করেন।[২] পতঙ্গদের প্রাকৃতিক বস্তুর ব্যবহারের ওপরও তার গবেষণা নিবদ্ধ হয়। তিনি লক্ষ্য করেন, কীভাবে শিকারী বোলতা তাদের বাসার মুখ বন্ধ করার জন্য ছোট ছোট পাথরের টুকরো ব্যবহার করে থাকে। প্রজননকালে ঘুরঘুরে পোকা কি ভাবে শিকারীদের আক্রমণ থেকে তার ডিমগুলিকে রক্ষা করার জন্য পেছনের পা দিয়ে কাদার তৈরী গোলক নির্মাণ করে, তা তিনি পর্য্যবেক্ষণ করেন।[২] এছাড়া ব্যাঙাচি থেকে পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙে পরিবর্তনের সময় কিছু ব্যাক্টেরিয়ার উপকারিতা সম্বন্ধেও তিনি গবেষণা করেন। ব্যাঙাচির ওপর পেনিসিলিন ওষুধ প্রয়োগ করে তিনি লক্ষ্য করেন যে, সেগুলি পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙে পরিবর্তিত হতে সক্ষম হয় না, বরং পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙাচিতে রূপান্তরিত হয়।[৩]

তার প্রায় বাইশটি গবেষণাপত্র ন্যাচারাল হিস্ট্রি সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় সামজিক কীটপতঙ্গের ওপর তার গবেষণা সম্বন্ধে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য প্যারিসের ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য স্টাডি অব সোশ্যাল ইন্সেক্টস নামক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি ডাক পান। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকার জন্য তাকে বিভিন্ন সময়ে বৈষম্যের শিকার হতে হয়।[২]

বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ[সম্পাদনা]

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে গোপালচন্দ্র সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেন। পুলিন বিহারী দাসের সঙ্গে তিনি অক্লান্ত ভাবে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের কর্মকাণ্ডে শ্রম দেন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জ্ঞান ও বিজ্ঞান নামক বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এছাড়া তিনি ভারতকোষ নামক বাংলা ভাষার একটি বিশ্বকোষ রচনাতেও সহযোগিতা করেন।

প্রকাশিত গ্রন্থ[সম্পাদনা]

এ পর্যন্ত গোপালচন্দ্রের ১৬ প্রকাশিত বই এর নাম জানা যায়। এছাড়া তার বহু লেখা অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য স্মরণ সংখ্যার তথ্যমতে তার লেখার সংখ্যা হাজার খানেকের মত, যার সবকিছু এখন আর উদ্ধার করা সম্ভব নয়।[৪]

  • আধুনিক আবিষ্কার,
  • বাংলার মাকড়সা (১৯৪৯)
  • করে দেখ (১ম খণ্ড ১৯৫৩, ২য় খণ্ড ১৯৫৬),
  • আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু (১৯৭৬),
  • বাঙলার কীটপতঙ্গ (১৯৭৫),
  • মনে পড়ে (আত্মজীবনী- ১৯৭৭),
  • পশু পাখি কীট পতঙ্গ (১৯৮২),
  • বিজ্ঞানের আকস্মিক আবিষ্কার (১৯৮৪),
  • বাঙলার গাছপালা (১৯৮৬),
  • বিজ্ঞান অমনিবাস (১৯৮৭),
  • জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা খবর,
  • বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান সংবাদ,
  • মানব কল্যাণে পারমাণবিক শক্তি,
  • আণবিক বোমা (অনুবাদ গ্রন্থ),
  • মহাশূন্যে অভিযান (১৯৫৮),
  • জীববিজ্ঞান (পাঠ্যপুস্তক)।

সম্মাননা[সম্পাদনা]

গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে আনন্দ পুরস্কার এবং ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার কীট পতঙ্গ নামক গ্রন্থ রচনার জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর তিন মাস পূর্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক ডি.এসসি. ডিগ্রী প্রদান করে।[৫] ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে অবদানের জন্য গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরস্কার প্রচলন করেন।[৬]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. বাংলার কীটপতঙ্গ (৭ম সংস্করণ)। কলকাতা: দে'জ পাবলিশিং। ২০০৪ [প্রথম প্রকাশ ১৯৭৫]। 
  2. Amit Chakraborty (সেপ্টেম্বর ২০০২)। "Gopal Chandra Bhattacharya: One Who Observed Insects" (পিডিএফ)Dream 2047: Monthly newsletter of Vigyan Prasar4:12: 19। ১২ এপ্রিল ২০০৬ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ 
  3. চট্টোপাধ্যায়, পৌলমী দাস। "পোকামাকড়ের সঙ্গে জীবন"anandabazar.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৮-১১ 
  4. গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য, এম. এ. আজিজ মিয়া (১ম সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলা একাডেমী। ১৯৯৩ [প্রথম প্রকাশ ১৯৯৩]। 
  5. "Annual Convocation"University of Calcutta। ২৮ মে ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ 
  6. "Gopal Chandra Bhattacharya Award for science popularization" [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]